আমার ছাত্র জীবনের পুরো সময়টা কেটেছে এরশাদের জাতীয় পার্টি ও খালেদা জিয়ার বিএনপি শাসনামল দেখে। আমাদের কিশোর বয়স থেকে বেড়ে উঠতে উঠতে যৌবনে পা রেখেছি যখন ঠিক সেই সময়টায় আবার দীর্ঘ একুশ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকা দল আওয়ামী লীগকে জনগণ ভোট দিয়ে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন করে। তখন আমি অনার্স শেষ বর্ষের ছাত্র এবং জীবনে দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের নির্বাচনে ভোট দেবার সুযোগ পাই। রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের এই ব্যাপারটা আমাদের প্রজন্মের কাছে কিছুটা ব্যতিক্রম হিসেবে গণ্য হয়েছিলো। কেননা এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে আমাদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিলো রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত রেডিও ও টেলিভিশন। একমাত্র পেপার পত্রিকা ব্যতিত সেই দুই রাস্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের কোন প্রচার বা শেখ মুজিবুর রহমানের নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হতো না। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সংক্ষিপ্ত আমলে দেশবাসী ও আমাদের মতো তরুণ ও যুবকদের আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করার কিছুটা সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আমাদের কিশোর বয়সে গ্রামে বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনের সময় স্লোগান শুনেছি "হাসিনা রে হাসিনা, তোর কথায় নাচি না। তোর বাপের কথায় নেচে, দেশ গেছে ভেসে"। এছাড়া "নৌকায় ভোট দেবো না, কচু ঘুটা খাবো না" জাতীয় স্লোগানও শুনেছি অহরহ এরশাদ শাসনামলে। শুধুমাত্র তত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই উন্মুক্ত স্থানে মাইকে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাজানো শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেছি দুই একবার। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে দুই দলের শিশুসুলভ কামড়াকামড়ি দেখেছি তখন, বিএনপির দাবী মেজর জিয়াই একমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক। সেই দাবীর পক্ষে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণের খন্ডিত অংশ বিটিভি বা রেডিওতে প্রচার করা হতো তাদের শাসনামলে। সেই প্রচারিত অংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে উচ্চারিত বাক্যটি বাদ দিয়ে "I Major Ziaur Rahman declare the independent of Bangladesh" এভাবেই শুনতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম। মনে আছে ১৯৯১ সালে এইচএসসি পরীক্ষা শেষে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং করতে এসে সেই প্রথমবারের মতো ভিসিআর এ আমার খালাতো ভাইয়ের সাথে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার পুরো ভিডিও ও অডিও দেখেছিলাম ও শুনেছিলাম।
ইতিহাসের বিকৃতি বা এক ধরণের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের প্রজন্মের অনেকেই বলতে গেলে এন্টি আওয়ামীলীগ সেন্টিমেন্ট নিয়ে বেড়ে উঠেছি। কারণ এরশাদ সাহেব শেখ মুজিবের স্বঘোষিত খুনীদের ফ্রিডম পার্টির রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে এবং কুড়াল মার্কায় নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে সহযোগিতা করেছে। আর বিএনপি তো জন্মই নিয়েছে আওয়ামীলীগের সকল বিরুদ্ধবাদীদের একাট্টা করে। বিশেষত ১৯৭৫ সালে ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের পথ ধরে জাদরেল কিছু বাম নেতাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ পদবী দিয়ে আওয়ামী চেতনার বিরুদ্ধে শক্ত রাজনৈতিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার নতুন নতুন তত্ত্ব হাজির করেন মেজর জিয়া। সকল আওয়ামী বিরোধীরা তখন কোমর বেঁধে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করে। তাই সবকিছু মিলিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিবুর রহমান ও পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যার মাধ্যমে যে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিলো সেই ধারায় আওয়ামী লীগ চরমতম ভোগান্তির ভিতর দিয়ে পার করেছে।
স্কুল জীবনে বই পুস্তক থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানার সুযোগ তেমন ছিল না আমাদের। অনেকটা ভাসা ভাসাভাবে আশেপাশের মুরব্বীদের মুখে বা গ্রামের বাজারে চায়ের দোকানে দুই দলের সমর্থকদের তর্কযুদ্ধ থেকে যতোটুকু জানতে পেরেছিলাম ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের শাসনামল সম্পর্কে তাতে বুঝেছিলাম- একদলীয় শাসন ব্যবস্থা হিসেবে বাকশাল কায়েম, অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও অধিকাংশ সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা, চুয়াত্তরের দূর্ভিক্ষ, রক্ষী বাহিনীর অত্যাচার, সিরাজ শিকদার ও জাসদের উপর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, রিলিফ সামগ্রী লুটপাট, মজুতদারি ও কালোবাজারি ইত্যাদি কারণে সেনাবাহিনীর একটা ক্ষুব্ধ অংশ বিশ্বাসঘাতক আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোসতাকের সাথে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র করে।
সেজন্যই বলছিলাম আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশ সাধারণ পরিবারের সন্তানেরা আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠেছিলো। শুধুমাত্র যারা পারিবারিকভাবে আওয়ামী সমর্থক ছিলো তাদের সন্তানেরা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়েছে। পাশাপাশি এদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বড় অংশ, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবিসহ সাংষ্কৃতিক কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামীলীগের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। এমন বিপর্যয়ের মধ্যে দল হিসেবে আওয়ামীলীগকে টিকিয়ে রাখতে শেখ মুজিবের অন্ধ ভক্ত সাধারণ মানুষদের একটি অংশ, বেশ কিছু ত্যাগী নেতাদের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন, ডঃ কামাল হোসেন সহ অনেকে বুঝতে পারেন এই চরম দুঃসময়ে দলকে সংগঠিত রেখে নেতা কর্মীদের মনোবল ধরে রাখতে মুজিব পরিবারের কাউকে দলের হাল ধরতে হবে। সেই উপলব্ধি থেকে ডঃ কামাল হোসেন শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহন করেন। যদিও পরবর্তীতে আমরা দেখেছি ডঃ কামাল হোসেন নিজেই শেখ হাসিনার সাথে মতদ্বন্দ হয়ে আওয়ামী লীগ ছেঁড়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
প্রায় ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে ১৯৮১ সালের ১৭ই মে শেখ মুজিবের বড় কন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে হাল ধরার পর নেতা কর্মীরা বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে। পচাত্তরের পর যারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছিলেন তাদের অনেকেই শেখ হাসিনার সান্নিধ্য পেতে তৎপর হয়ে আওয়ামী লীগের নতুন যাত্রায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করে। আমার পরিচিতদের মধ্যে অনেককেই দেখেছি শেখ হাসিনার নেতৃত্ব নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করতে, তাদের মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার স্বপ্ন নতুন করে দানা বেঁধে ওঠে। ধীরে ধীরে দলটি স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলতে থাকে।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ১২ই জুন, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত হয়। সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের বিপরীতে ২৮১জন সতন্ত্র প্রার্থীসহ ৮১টি দল থেকে মোট ২৫৭৪ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেয়। ৩০০টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি, বিএনপি ১১৬টি, জাতীয় পার্টি ৩২টি এবং জামায়াত ৩টি আসনে জয়লাভ করে। আওয়ামীলীগ জাতীয় পার্টি ও বামদলের সাথে জোটগতভাবে ঐক্যমতের সরকার গঠন করে। উক্ত নির্বাচনে সতন্ত্র প্রার্থীরা ০.৬৭% এবং দলীয় প্রার্থীরা ৭৪.৮২% ভোট লাভ করে। দীর্ঘ একুশ বছর পর আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার হাত ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার সুযোগ পায়। এক্ষেত্রে আমার মনে আছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিটিভিতে সকল দলের পক্ষ থেকে ভোট চেয়ে ভাষণ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিলো। আওয়ামী লীগ নেত্রী সেই ভাষণে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন অতীতের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে জনগণ যেন আরও একটিবার আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার সুযোগ দেয়।
যদিও আওয়ামী লীগের প্রতি আমার তেমন আস্থা ছিল না কিন্তু ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মেয়াদে বিএনপির দূর্বল শাসন ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কালিমালিপ্ত করায় শেখ হাসিনার কান্নায় বিগলিত হয়ে পরিবর্তনের নতুন আশায় আমার ভোটটা নৌকা মার্কাতে দিয়েছিলাম! আমার এক ঠাট্টা সম্পর্কীয় আত্মীয় যিনি ঘোর আওয়ামী লীগ বিরোধী তিনি কিছুতেই এ কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তাঁর কথা হলো সুস্থ মস্তিষ্কের কোন মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে পারে না। তিনি লোকজনকে ডেকে ডেকে আমাকে দেখিয়ে ঠাট্টা করে বলতে লাগলেন- দেখেন দেখেন নতুন একটা বলদ, এই বলদ কিনা নৌকায় ভোট দিয়েছে! মজার ব্যাপার হচ্ছে সেবার আমার ভোট দেয়া নৌকার প্রার্থী জিততে পারেননি কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিলো। তখন থেকেই বুঝেছিলাম ভোটার হিসেবে আমার মতামতের দাম কিন্তু কম নয়। আমি আমজনতার যথার্থ প্রতিনিধি বটে, কারো ভোট ব্যাংক নই, যে দল বা ব্যক্তি আমার প্রত্যাশা পুরণ করতে পারবে না বা ভুল করবে আমি তাকে আমার ভোট দেবো না।
আসলে আমি কলেজ জীবনে অজপাড়াগাঁ থেকে বিভাগীয় শহরে স্থানান্তরিত হবার কারণে দেশের রাজনৈতিক পাঠ নেয়ার অবারিত সুযোগ পেয়েছিলাম। মনের আনন্দে দেশের অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকা, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন কিম্বা বিভিন্ন দলের ছাত্র নেতাদের জনসভার ভাষণ থেকে অনেক অনেক তথ্য জানতে পারছিলাম। এর আগে একটি পর্বে বলেছি বিএল কলেজের ইসলামী ছাত্র শিবিরের অমায়িক ব্যবহারের কারনে এবং নেতাদের সুবক্তব্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মনে মনে শিবিরকে সমর্থন করতাম। তবে দৈনিক ইনকিলাব, আজকের কাগজ, ভোরের কাগজ, দৈনিক প্রথম আলো এসকল পত্রিকার সম্পাদকীয় ও নামকরা কলাম লেখকদের মতামত ও রাজনৈতিক ফিচারগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান সংগ্রহ করেছি। প্রকৃতপক্ষে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন ছাত্রদের ভূমিকা, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এবং সবশেষে এরশাদ সরকারের পতনের পুরো ঘটনাপ্রবাহ থেকেই আমার মূল রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো।
কিন্তু জাতির জীবনে দূর্ভাগ্য হিসেবে আমাদের প্রজন্ম প্রত্যক্ষ করে দুটি শত্রুভাবাপন্ন দলকে, যারা শুধুই অতীত ঘটনাগুলোর চর্চা করতে ভালোবাসে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে ও ভবিষ্যতে কি কি জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ নিতে হবে সেই গঠনমূলক রাজনৈতিক চিন্তার বাইরে সংকীর্ণ দলীয় মনোভাব ও অতীতের ভুল ত্রুটিগুলোকেই মূখ্য হিসেবে জনগণের সামনে তুলে ধরে। আমাদের যৌবনের অধিকাংশ সময়কালই আওয়ামীলীগ ও বিএনপির পারষ্পারিক চরম শত্রুতামূলক রাজনৈতিক অবস্থান দেখতে দেখতে কেটেছে। দুই দলের অতীত নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভয়াবহ বিদ্বেষ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। পুরো জাতিকে দুটো বিরোধী শিবিরে বিভক্ত করে দিয়ে একটি দল শুধু অন্য দলটিকে হেয় প্রতিপন্ন করার নিষ্ঠুরতায় মেতে ওঠেছে। এসব দেখতে দেখতে আমাদের অনেকের মধ্যে দুই দলের প্রতিই একটা বিতৃষ্ণার জন্ম নিয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে বিকল্প কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে আমাদের সমর্থন দেয়ার মত খুঁজে পাইনি।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।