মৎস্য বিজ্ঞানী হিসেবে প্রত্যাশিত চাকরি পেয়েছি, বলতে গেলে তেমন কাজের চাপও নেই, অফিসে বসেও সহকর্মীদের সাথে চলে আড্ডা, আবার অফিস শেষেও সেই আড্ডা। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সদ্য নিয়োগ পাওয়া মৎস্য বিজ্ঞানী কর্মকর্তাদেরকে একজন সিনিয়র কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত করা হলো। কিন্তু উর্ধবতন কর্মকর্তাকে খুব সমঝে চলা বা কথায় কথায় স্যার স্যার বলে মুখে ফেনা তোলার মতো ব্যাপার ছিলো না। একমাত্র মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ব্যতীত আর সকল সিনিয়রদের সাথে ভাই ভাই বলে সম্বোধনের প্রচলন থাকায় বেশ আন্তরিক একটা কর্ম পরিবেশ পেয়ে খুব ভালো সময় কেটে যাচ্ছিলো। আরও পরে কিছু নিয়মিত গবেষণা কাজের সাথে যুক্ত হবার সুযোগ পেলাম, অনেকটা মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শণ, গবেষণা পুকুরের মাছের বৃদ্ধি পরীক্ষা, রেকর্ড লিখে রাখা ইত্যাদি টুকটাক কাজ।
ছয় মাস পার হলে গবেষক হিসেবে নিজের কাছে যে ধরনের প্রত্যাশা করেছিলাম চাকরিটা পাবার আগে সেই পর্যায়ে হোচট খাওয়া আরম্ভ হলো। গবেষক থাকবে ল্যাবরেটরিতে, মাঠ থেকে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সেগুলো বিশ্লেষণ, প্রাপ্ত ফলাফল থেকে আয়োজন করা হবে সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপ। গবেষণার উপর বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান জার্নালে লেখালেখি হবে, সেসব লেখার জন্য উর্ধতন বিজ্ঞানী জুনিয়র বিজ্ঞানীদের গাইড করবে। কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গ হতে থাকলো স্পষ্টভাবেই। উক্ত কার্যক্রমের বিপরীতে দেখতে পেলাম ছোটখাট বিষয় নিয়ে পেশাগত দ্বন্দ, গবেষণা পুকুরের মাছ ভাগাভাগি নিয়ে ক্ষুদ্র মানসিকতা, একজনের পিছনে আরেকজনের কুটকাচালি ইত্যাদি দেশীয় কায়দা কানুনের প্রদর্শণ।
এভাবে বছর ঘুরে দেখলাম আমার অজান্তেই আমাকে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রিএজেন্ট ও যন্ত্রপাতি ক্রয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কেনাকাটা সম্পন্ন হবার পর ঠিকাদারের বিল দেয়ার জন্য নির্দিষ্ট দাপ্তরিক পদ্ধতি অনুসরণের ক্ষেত্রে আমার স্বাক্ষর নিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ পদের কর্মকর্তার পিওনের হাতে। অনেকগুলো কাগজপত্রে চোখ বুলাতে চাইলে পিওন বিগলিতভাবে হেসে বলে- বড় স্যার তাড়াতাড়ি স্বাক্ষর করে দিতে বলেছেন, ঠিকাদার বিল নেয়ার জন্য বসে আছে! পিওনের বিগলিত হাসি দেখে সন্দেহ থেকে প্রশ্ন করি- এগুলো কবে কেনা হয়েছে, ল্যাবে তো এসবের কিছুই দেখিনি! পিওন আবার বিগলিত হাসি দিয়ে বলে- এভাবেই সবসময় কেনাকাটা হয় স্যার! আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলেও ভেবে নিই ঠিকাদার হয়তো পরবর্তীতে মালামাল সরবরাহ করবে সেই বিশ্বাস থেকে স্বাক্ষর করে দিই। কারন আমরা তখন সবে চাকরি জীবন আরম্ভ করেছি, দুর্নীতির রাস্তাঘাট সম্পর্কে তখনো তেমন ধারনা তৈরি হয়নি।
সরকারি চাকুরেদের দুর্নীতির পাঠ নিতে তখনো বাকী ছিলো। চাষীদের জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজন করে বরাদ্দ অনুযায়ী ব্যয় না করে পাওয়া অর্থ কার কার পকেটে ঢুকছে সেটাও একসময় গোচরীভূত হলো। ড্রাইভারদের সাথে চলাফেরা করতে করতে ভাব জমিয়ে কিভাবে তেল বিক্রি চলে, পেট্রল পাম্পের সাথে যোগসাজশে কিভাবে অতিরিক্ত বিল ভাউচার করে তেলের টাকার ভাগবাটোয়ারা চলে সেসব অভিজ্ঞতাও হতে থাকলো দিনে দিনে। যুবক বয়স, দুর্নীতির প্রতি এক ধরনের বিদ্রোহী মনোভাব থাকায় আমার একধাপ উপরের কর্মকর্তার সাথে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি। তিনি পরামর্শ দেন চোখ বুজে চাকরি করে যেতে, ওসব বিষয়গুলো সব সরকারি অফিসে একই নিয়মে চলে, এগুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে উল্টো বিপদ তৈরি হবে।
সিনিয়রের কথায় ও পরামর্শে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়লাম। এলাম বিজ্ঞানী হবার উদ্দেশ্যে, কিন্তু দেখতে পেলাম এখানে বৈজ্ঞানিক কার্যক্রমের অংশ সর্বোচ্চ কুড়ি থেকে পঁচিশ শতাংশ আর বাদবাকি লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। যখন চাকরির বয়স আঠারো মাস পার হলো তখন কিছুতেই আর নিজেকে বিজ্ঞানী ভাবতে পারছিলাম না, এখানে সেখানে নতুন চাকরির আবেদন করতে মনস্থির করতে থাকলাম। যেহেতু প্রকল্প ভিত্তিক চাকরি, মেয়াদ শেষে ভবিষ্যতে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ হবার সম্ভাবনা কতোটা তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা হতাশা, কিছুটা বিভ্রান্তি থেকে নতুন একটা সরকারি প্রকল্পের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিলাম এবং মামার তদবির ছাড়াই চাকরিটা পেয়ে গেলাম!
বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প ভিত্তিক চাকরিগুলো রাজস্ব খাতে আত্তীকরণ হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে এমন তথ্য জানার পর এবং মৎস্য বিজ্ঞানী হবার বাসনায় ভাটা পড়াতে ২৮৫০ টাকা স্কেলের বেতনের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ২০০০ সালে মৎস্য সম্প্রসারণ কর্মকর্তা পদে পাবনার সুজানগর উপজেলায় প্রথম শ্রেণীর গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করলাম। নতুন প্রকল্পের বেতন একটু আকর্ষনীয় ছিলো যা সাকূল্যে ৬৮০০ টাকা, সেই আমলে ব্যাচেলর একজন কর্মকর্তার জন্য খুব যে বেমানান ছিলো তা বলা যাবে না। কিন্তু উপজেলা অফিসের আসন ব্যবস্থা, আবাসন, অফিসের আসবাবপত্র ইত্যাদি ক্ষেত্রে সীমাহীন অবনমন ঘটলো বিজ্ঞানী হিসেবে কাঁটিয়ে আসা প্রায় দুই বছরের অভিজাত সুযোগ সুবিধার বিপরীতে। তবে সুযোগ পেলাম দেশের প্রশাসনিক একটি ইউনিট হিসেবে উপজেলা পরিষদ থেকে জনসাধারণের জন্য কিভাবে সেবা প্রদান করা হয় সেটি চাক্ষুষ করার।
বিজ্ঞানী হিসেবে যেখানে শুধুমাত্র একই একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ডের মানুষদের সাথে কাজ করার সুযোগ ছিলো সেখানে উপজেলা প্রশাসনে বহু ধরনের মানুষ ও দপ্তরের সাথে পরিচিতি ঘটলো। একই সাথে উন্মোচিত হতে থাকলো স্থানীয় পর্যায়ে দুর্নীতির বহুবিধ অলিগলি ও ফাঁকফোকর। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তার দপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ, ভূমি অফিস, সাব-রেজিস্টারের দপ্তর ইত্যাদি কার্যালয়গুলোর সেবা সম্পর্কে যেমন ধারনা পেলাম একইসাথে বিভিন্ন পদবীর কর্মকর্তাদের জীবন যাপনের তারতম্যও বুঝতে অসুবিধা হলো না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে মাঠ পর্যায়ের সমগ্র প্রশাসন কিভাবে ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির পসরা সাজিয়ে বসে থাকে তা উপজেলা পর্যায়ে চাকরি করার সুযোগ না পেলে এ জীবনে অমন অমূল্য অভিজ্ঞতা হবার কোন সুযোগ ছিলো না।
এছাড়া স্থানীয় সরকারি দলের রাজনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের দৌরাত্ম, প্রশাসনের সাথে রাজনীতির মানুষদের মিলিমিশে দুর্নীতির মহা উৎসব দেখার অভিজ্ঞতাও হয়েছে প্রায় পাঁচ বছরের উপজেলা পর্যায়ের সরকারি চাকরিতে। অনৈতিক সুবিধা দেয়া নেয়ার মাধ্যমে অবৈধ লেনদেনের অলিখিত সিন্ডিকেটগুলো কিভাবে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে পুকুর, নদী বা সাগর চুরি করছে সেগুলো বাইরে থেকে বোঝার উপায় থাকে না। শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মী, কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষভাবে সাথে যুক্ত মানুষেরাই নয় আওয়ামী লীগ সভাপতি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ সব্বাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেসব চুরি চামারি চালিয়ে যায়। সে এক অদ্ভূত ঐক্যমত্য, বিশেষত জুন মাসে আসা বরাদ্দগুলো রাত জেগে পেপার ওয়ার্কের মাধ্যমে পুরো টাকাই আত্মসাৎ করার ঐতিহ্যবাহী সরকারি অফিসের তুঘলকি কান্ড কারখানা দেখলে আপনি বিভ্রান্ত হতে বাধ্য। কেননা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে কপালে কালো দাগ ফেলে দেয়া উপজেলার কোন একটি দপ্তরের কর্মী বা কর্মকর্তা অবলীলায় অবৈধ লেনদেন চালিয়ে যায় অনেকটা যেনো নিজেদের অবাধ লুটপাটের অধিকার আছে এমনই নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায়!
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।