উপজেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্ম পরিধি মূলত ইউএনও বা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কেন্দ্রিক যিনি প্রশাসন ক্যাডার থেকে নিযুক্ত হন। একজন ইউএনও সাধারণত উপজেলা পরিষদের আওতায় বাস্তবায়িত সকল কার্যক্রমের সমন্বয় করে থাকেন। এ কারনে উপজেলা পরিষদের অধীন সকল দপ্তরের কর্মকর্তা বা কর্মীগণ ইউএনও সাহেবকে প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে মেনে তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ করে থাকেন। যদিও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইত্যাদি ব্যক্তিগণ বিসিএস পর্যায়ে ইউএনও সাহেবের চেয়ে সিনিয়র হয়ে থাকেন। তবে সরকারের আমলাতান্ত্রিক এই উপজেলা ব্যবস্থাপনা মোটামুটিভাবে সবাই মেনে নিয়েছেন, প্রশাসন ক্যাডারের এই আধিপত্য নিয়ে আমরা বলাবলি করতাম ব্রাহ্মণ ক্যাডার বনাম নমঃশূদ্র ক্যাডার!
আমি ২০০০ সালের মার্চ মাসে মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্পে পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলায় প্রথম যোগদান করি। পড়বি না পড় মালির ঘাড়েই, সেখানে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার পদে যিনি আসীন ছিলেন তাঁকে নিয়ে অন্যান্য দপ্তরের কর্মকর্তাদের মনোভাব বুঝতে পেরে কিছুটা হতাশ হতে হলো সদ্য বিজ্ঞানী হিসেবে চাকরি ছেঁড়ে আসা মৎস্য সম্প্রসারন কর্মকর্তা পদে। প্রকল্পের চাকরি হলেও রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরে গেজেটেড কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপত্র পেয়েছিলাম তাই নতুন সিল বানিয়ে আগত সেবা প্রার্থীদের ছবি ও বিভিন্ন কাগজপত্র সত্যায়িত করে দেয়ার একটা বাড়তি আনন্দ অনুভব করছিলাম। কিন্তু আমার অফিসের বস ছিলেন প্রমোটি কর্মকর্তা, এরশাদ সরকারের আমলে নাকি মৎস্য অধিদপ্তরে কর্মরত বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করা কর্মীদের অটো প্রমোশন দিয়ে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা পদে বসিয়ে দিয়েছিলো! দুর্ভাগ্যবসতঃ এসএসসি পাশ সেই প্রমোটি অফিসারের অধীনে আমার যোগদান করতে হলো এবং অনেকটা অজ্ঞ কিন্তু ব্যাপক ভাব প্রদর্শনকারী একজন বসের কাছ থেকে নবীন কর্মকর্তা হিসেবে শেখার কোন সুযোগ পেলাম না।
মেট্রিক পাশ বসের শোক কেটে যাচ্ছিলো উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার, কৃষি, ভেটেরিনারি সার্জন, শিক্ষা, সমাজসেবা, যুব উন্নয়ন, মহিলা বিষয়ক ইত্যাদি কর্মকর্তার সাথে পরিচিত হয়ে। একেকটা উপজেলা একটা মিনি সেক্রেটারিয়েট, উপজেলা পর্যায়ে চাকরি না করলে জীবনের অনেক অনেক অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হতাম। কারন সেখানে যাদের সাথে পরিচিত হয়েছি তাঁরাই পরবর্তীতে জেলা, বিভাগীয় বা কেন্দ্রীয় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোতে সিনিয়র পদবীর কর্মকর্তা হিসেবে পদন্নোতি পেয়েছেন। যেমন আমার জীবনে উপজেলা পর্যায়ে পাওয়া প্রথম ইউএনও সাহেব একসময় নির্বাচন কমিশনে সচিব হিসেবে পদায়ন পেয়েছিলেন। সেই সুবাদে আমি নিজের এনআইডি সংশোধন করে নিয়েছিলাম কোন ঝুট ঝামেলা ছাড়াই। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় সেবা প্রদানকারী দপ্তরের কার্যক্রম সম্পর্কে জানা ও শেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রার্থীদের সাথে আন্তঃসম্পর্ক স্থাপিত হয়, উদ্ভূত নানান সামাজিক বা আইন-শৃঙ্খলা জনিত সমস্যা সমধানে অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়।
উপজেলা পর্যায়ে প্রথম চাকরির অভিজ্ঞতায় আমার প্রথম বিস্ময়ের জায়গা ছিলো পুলিশের অমানবিক ডিউটি দেখা। আমার সাথে উপজেলা ডাক বাংলোয় থাকতো পুলিশের তিনজন সাব ইন্সপেক্টর পর্যায়ের কর্মকর্তা, তাদের সারা রাত জেগে পেট্রল ডিউটি শেষ করে একটু বিশ্রাম না নিতেই আবার থানায় হাজির হয়ে বিভিন্ন মামলার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা দেখে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম, তাই তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের বিপরীতে নিজেকে মহা সুখী ভাবতাম। ছয় সাত মাস পেরিয়ে গেলেও বলতে গেলে প্রকল্পের তেমন কোন কাজ আরম্ভ হয়নি, আমি একেকদিন একেক দপ্তরের কর্মকর্তার সাথে মটরসাইকেলে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কার্যক্রম পরিদর্শন করি। ডাকবাংলোয় পাশাপাশি কক্ষে থাকার কারনে বেশি খাতির হয় উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জনের সাথে, তাঁর পিছু পিছু ঘুরে গরু ছাগল হাঁস মুরগির চিকিৎসা কর্মকান্ড দেখি।
তবে পাবনার সুজানগর উপজেলায় সবচেয়ে স্মৃতিময় হয়ে আছে তৎকালীন স্বাক্ষরতা প্রকল্পের আওতায় আয়োজিত বিভিন্ন বিনোদন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্টানগুলোতে ইউএনও সাহেবের সাথে অথবা তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে প্রধান অতিথির চেয়ার অলংকৃত করার সুযোগ পাওয়ার ঘটনা সমূহ। পাবনার আঞ্চলিক ভাষায় মঞ্চায়িত নাটকগুলো ভীষণ উপভোগ করেছি তখন, পাবনার ভাষায় একটা মায়াবী টান আছে। উপজেলা পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অতুল সম্মান পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে সরকারি চাকরি করতে গিয়ে। অতি অল্প বয়সেই বড় বড় অনুষ্টানের প্রধান বা বিশেষ অতিথি হিসেবে কথা বলার সুযোগ পেয়ে নিজের দূর্বলতাগুলো থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছি, নিজেকে নেতৃত্ব দানে যোগ্য করার জন্য উপযুক্ত প্লাটফর্ম ছিলো এই উপজেলা পর্যায়ের চাকরি।
পাশাপাশি কিছু নেতিবাচক অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হতে হয়েছে যার পুরোটাই বাংলাদেশের রাজনীতির আসল চরিত্রগত দোষে দূষিত। অনেকেই কাজ নিয়ে আসতো আমার কাছে, নিজের নাম না বলে প্রথম পরিচয় দিতো আমি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা ছাত্রলীগের অমুক পদে আছি। হাসিমুখে বলতাম- ভাই আপনার নামটা তো আগে বলবেন? সুজানগর যোগদানের একদিন পরে অফিসে গিয়ে দেখি লুঙ্গী পরিহিত একজন ব্যক্তি আমার মেট্রিক পাশ বসের কক্ষে চেয়ারে পা তুলে অত্যন্ত রিল্যাক্স মুডে বসে পান চিবুচ্ছেন আর আমার বসের সাথে পা নাচিয়ে নাচিয়ে অত্যন্ত হেয়ালীভরে কথাবার্তা বলছেন। আমি কক্ষে প্রবেশ করতেই আমার বস অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে কিন্তু কাচুমাচুভাবে চেয়ারে পা তুলে বসা ব্যক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন- ইনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি! পরে জেনেছিলাম তিনি একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক, অথচ আওয়ামী লীগের সভাপতি বিধায় একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার সামনে চেয়ারে পা তুলে বসার অধিকার রাখেন। এমন নিম্ন রুচির অভব্য শিক্ষকরা রাজনীতির মাঠে বা তাঁদের অনুসারীদের সম্মানিত ব্যক্তিদের কিভাবে সম্মান করতে শেখাবেন? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বা নিজের স্কুলের শিক্ষার্থীদের কি সুশিক্ষা দেবেন?
অথচ একুশ বছর ক্ষমতা বঞ্চিত আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতা পেয়ে অতীত থেকে কোন শিক্ষাই নিয়েছিলো বলে আমার মনে হয়নি। ২০০০ সাল ছিলো তাদের ক্ষমতার মেয়াদের শেষ বছর, প্রচলিত চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব, সন্ত্রাসী কার্যক্রম এর সকল আকাম কুকামের কারনে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। ফেনীর ত্রাস জয়নাল হাজারি, নারায়নগঞ্জের শামীম ওসমান গংদের সীমাহীন অত্যাচার ও আস্ফালনে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যারা ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগকে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছিলাম তারা চরম হতাশ হয়ে পড়ি। শেখ হাসিনা অতীতের ভুল ত্রুটি মাফ করে দেয়ার আহ্বান করেছিলো কেঁদেকেটে কিন্তু সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ না করে দলীয় ক্যাডার বাহিনীর মাধ্যমে অপশাসন চালিয়ে পুরো মেয়াদটাই অতীতের পথেই হেঁটেছে আওয়ামীলীগ!
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।