আমার জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। পূর্ব পাকিস্থান নামক এক খিচুড়ি রাষ্ট্রের বাসিন্দা ছিলেন আমার বাপ দাদা সহ চৌদ্দ পুরুষ বা পূর্ব পুরুষগণ। কিন্তু আমি আক্ষরিক অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশের সন্তান, আমার জন্ম সাল ও মাস অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এর পরেই হয়তো মাতৃ জঠরে আমার ভ্রূণ মনুষ্যাকৃতি ধারণ করতে আরম্ভ করেছিলো। সেই সুক্ষ হিসেবে বৃটিশ কতৃক ব্যবচ্ছেদকৃত পাকিস্থান নামক ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্রের সাথে আমার কোন হিস্যা নেই। আক্ষরিকর্থেই আমি খাঁটি বাংলাদেশি এবং গত তিপ্পান্ন বছরে আমার মাতৃ ও পিতৃকূলে ১৯৭১ সালের নয় মাসে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্থানের পক্ষে কেউ সমর্থন দিয়েছিলেন বলে আমার জানা নেই।
তবে রক্তে উত্তরাধিকার সূত্রে কিছু রাজনৈতিক ভাবধারার এন্টিক্লাইমেক্স আমাকে তাড়িত বা পীড়িতও করে! কারণ গ্রামে বেড়ে উঠতে উঠতেই জেনেছি যে আমার পিতৃকূলের অনেকেই নকশালপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। যতোদুর শুনেছি ১৯৭১ সালে রাজনীতির ময়দানে বামধারার রাজনৈতিক দল ও সমর্থকেরা পূর্ব পাকিস্থানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে মূল পার্থক্য ছিল মস্কোপন্থী ও চীনাপন্থী হিসেবে। তবে সেসবের বাইরে আর একটা মতাদর্শের বামপন্থী রাজনীতির প্রচলন ঘটেছিলো ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়। সেই ধারার বেশকিছু প্রখ্যাত বামনেতাগণ পূর্ব পাকিস্থানে বিভিন্ন নামে বিপ্লবী কমিউনিষ্ট পার্টির ছত্রছায়ায় শ্রেণীশত্রু খতমের এক চরমপন্থী রাজনীতিতে বহু তরুণ যুবকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হন।
এই নকশালপন্থীরা শ্রেণীশত্রু খতমের নামে তৎকালীন গ্রামীন সমাজের অত্যাচারী মোড়ল, মাতব্বর, জোতদার, অন্যের সম্পদ দখলদার ধনিক ইত্যাদি শ্রেণীর মানুষদের হত্যা করে অথবা তাদের কথিত অবৈধ সম্পদ লুন্ঠন করে নিপীড়িত দরিদ্র মানুষের জন্য সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের আদর্শের কথা প্রচার করতেন। তৎকালীন বহু মেধাবী তরুণ ও যুবক সেই আদর্শের পক্ষে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে। আমি জন্মসূত্রে উক্ত এলাকার সন্তান, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই নকশালপন্থী রাজনীতি অচল হয়ে পড়লেও রক্তে তার বীজ বপিত হয়েছিলো সেটা কিঞ্চিৎ হলেও টের পাই। কেননা বিএল কলেজে এইচএসসি শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন শিবির প্রেমে পতিত হলেও পত্র পত্রিকায় পড়া রাজনৈতিক নিবন্ধন সমূহ ঘেঁটে আমার মূল রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তি তৈরি হয়ে যায় ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটকে ঘিরে।
আমি বলতে একটুও বিভ্রান্ত হচ্ছি না যে এরশাদ পতনের আন্দোলনে সকল দলের সমান অবদান থাকলেও আমাদের মতো তরুনদের কাছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি একটা স্বতন্ত্র ক্রেজ তৈরি হয়েছিলো। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের পুরো সময় জুড়ে তিনি ছাত্র সমাজের সামনে নিজেকে আপোষহীন নেত্রী হিসেবে উপস্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষাপটে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে (আমার দেখা এ যাবতকালের সর্বাধিক নিরপেক্ষ) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করেন। নিশ্চিত ক্ষমতা পেতে যাচ্ছেন এমন ধারনায় বিশ্বাসী আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা মনের দুঃখে বলেই ফেলেন নির্বাচনে সুক্ষ কারচুপি হয়েছে!
আমাদের সেই তরুণ বয়সে পরশ পাথরে যাচাই করে পাওয়া পরম এক ব্যক্তি ছিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তাঁর মত সৎ, বিচক্ষণ, চৌকষ, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ, অতুলনীয়, অনন্য এক ব্যক্তিত্ব আমি গত চৌত্রিশ বছরে এদেশে আর খুঁজে পাইনি। তিনি নব্বইয়ের গণভ্যুত্থানের ফলে সৃষ্ট সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণের জন্য সর্বজন মনোনীত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন নিরপেক্ষতা কাকে বলে? আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদের সংক্ষিপ্ততম শাসনকালের সেই স্বর্নালী স্মৃতি সত্যিই অতুলনীয় ও অমলিন হয়ে থাকবে আজীবন। তরুণদের ভোট জোয়ারে খালেদা জিয়া ক্ষমতারহন করলেও সংক্ষিপ্ততম সময়ের জন্য বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদের ক্ষুরাধার নিরপেক্ষতা নিয়ে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা আমার গণতান্ত্রিক আকাংখাকে তীব্রতর করে তুলেছিলো। খোলখুলিভাবেই মনে হতো এরকম মানুষই প্রয়োজন বাংলাদেশকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে এগিয়ে নেয়ার জন্য।
পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের বিপরীতে ৪২৪ জন সতন্ত্র প্রার্থীসহ ৭৫টি দল থেকে মোট ২৭৮৭ জন প্রার্থী অংশ নেয়। নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৪০টি আসন লাভ করে। অন্যান্য দলের মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ৮৮ টি, পতিত এরশাদের জাতীয় পার্টি অবিশ্বাস্যভাবে ৩৫ টি এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ১৮ টি আসন পায়। বিএনপি আসন বেশি পেলেও প্রাপ্ত ভোটের ফলাফলে দেখা যায় মোট কাস্ট হওয়া ভোটের ৩০.৮১ শতাংশ বিএনপি এবং ৩০.০৮ শতাংশ আওয়ামীলীগ পেয়েছে। সেসময় জামায়াতের ১৮ টি আসন পাওয়াও বেশ আলোচনার জন্ম দেয়, আমার মনে আছে সেদিন সারা রাত ভরে বিটিভিতে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা দেখেছিলাম। সে কি টান টান উত্তেজনা! সাংবাদিক আবেদ খানের তীক্ষ্ণ নির্বাচনী ফলাফল বিশ্লেষণ, এই এক আসনে আওয়ামীলীগ এগিয়ে যায় তো অন্য আসনে বিএনপি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ এক রাত বলা যায় সেই পঞ্চম জাতীয় সংসদের ফলাফল ঘোষণার রাতটিকে।
তবে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বেগম খালেদা জিয়া একাই পাঁচটি আসনে জয়ী হয়ে যে চমক দেখিয়েছিলেন এরশাদের পাঁচটি আসনে জয়ী হওয়াটা আমার কাছে রীতিমতো বিস্ময় ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিলো। আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না পতিত স্বৈরশাসক এরশাদের এই জয়কে, জেলে বসেই সেই নির্বাচন করেছিলো এরশাদ সাহেব, রংপুর অঞ্চলের মানুষ তাকে উজাড় করে ভোট বাক্স ভরে দিয়েছিলো। খুবই হতাশ হয়ে ভেবেছিলাম এই দেশের মানুষের কি কোনদিন সঠিক বিবেচনাবোধ জন্মাবে না? দীর্ঘ নয় বছরের দুঃশাসনে দূর্নীতির দায়ে জেলে যাওয়া প্রাক্তন জেনারেল আমরা বলতাম লেজেহোমো এরশাদ কিভাবে এদেশের নির্বাচনে জয়ী হতে পারে? অবশ্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্যকে মেনে নিতেই হয়েছিলো, মানুষের রায়কে তো আর অশ্রদ্ধা করা যায় না। তবে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম আমি, মনে হয়েছিলো জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা পঞ্চম জাতীয় সংসদের কপালে কলঙ্কের তীলক!
তবে আমার স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবেন ছোটখাট গড়নের হিটলারের মত মোচধারি এক অবিস্মরনীয় ব্যক্তিত্ব বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ। তিনি যে নিরপেক্ষতার নিরিখে কতোটা অনন্য ছিলেন পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধানদের কর্মকান্ড ও আচরণ দেখে কাউকেই ওনার ধারেকাছেও লাগেনি। সেই সময়ে আমার অবচেতন মনে ভাবনা আসতো যে এই মানুষটিকে আজীবনের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে যদি রেখে দিতে পারতাম?
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।