বাংলাদেশের আমজনতা হিসেবে নিম্ন বা নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনে লেখাপড়া, চাকুরি, ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার অনেকটা লটারি বা জুয়ার মতো। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন মেধাবী তরুন অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার থেকে কঠিন সংগ্রাম পার করে এলাকার আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষদের অথবা শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পার হয়ে দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যায়। এরপর টিউশনি বা পার্ট টাইম চাকরি যোগাড় করে নিজের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাবার পাশাপাশি পরিবারকেও সহযোগিতা করে কেউ কেউ। পরবর্তিতে এদের মধ্যেই কেউবা সরকারী বা প্রাইভেট চাকরি যোগাড় করে নিয়ে অথবা রাজনীতি বা ব্যবসায় নিয়োজিত হয়ে ক্যারিয়ারে সফলতার শীর্ষে উঠে যায়। অপরপক্ষে লটারি বা জুয়াতে যেমন হেরে গিয়ে সব খোয়ানোর সম্ভাবনা থাকে, কোন কোন মেধাবীদের ক্যারিয়ারে বিপর্যয়ও নেমে আসতে দেখেছি এই জীবনে।
এমন অনেক বন্ধু, আত্মীয়দের আমি নিজেই দেখেছি কিভাবে চোখের সামনে কঠিন সংগ্রাম করতে করতে লেখাপড়া চালিয়ে গেছে। আমাদের সময় শহরে বা গ্রামে লজিং মাস্টার রাখার প্রচলন ছিলো, এখন আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়াতে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও শিক্ষার্থীরা হোস্টেল বা মেসে থেকে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে নেয়। সেই লজিং যুগে ভাগ্যবান অনেক মেধাবী ছাত্রকে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল মনে করে মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে জামাই হিসেবে বেছে নিতেন কোন কোন লজিং বাড়ির অভিভাবক! আমার পিতাও কলেজ জীবনে দুরের এলাকায় এক আত্মীয় বাড়িতে লজিং থেকে লেখাপড়া করেছিলেন। অবশ্য তিনি সেইসব ভাগ্যবানদের মতো উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের অধিকারী বা অনেক সম্পদ গড়তে পারেননি। এমন অনেকেই মেধাবী হয়েও প্রত্যাশিত ক্যারিয়ার গড়তে পারে না বা ভালো শুরু করেও হোচট খায় জীবনের কোন একটি পর্যায়ে পৌঁছে। আমার পিতা ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে সরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে ক্যারিয়ার আরম্ভ করলেও ক্যারিয়ারের শেষ কুড়ি-পঁচিশ বছর একটি প্রাইভেট জুট মিলের একাউন্টেন্ট হিসেবে জীবন পার করতে বাধ্য হয়েছেন।
আমার প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। পিতার সম্পদের প্রাচূর্য না থাকলেও তিনবেলা খাবার ও চলনসই পোষাকের অভাবে পড়িনি। সেই প্রেক্ষাপটে গ্রামাঞ্চলের স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে একমাত্র শহরের সুযোগ সুবিধার অভাব ব্যাতিত সব পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলো বলেই মনে করি। এরপর ১৯৯১ সালে স্টার মার্কস নিয়ে এইচএসসি পাশ করেও দেশের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার জুয়ায় প্রথম বছরে অনেকের মতো আমিও পরাজিত হলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনটিইতেই ভর্তির সুযোগ না পেয়ে চরম হতাশায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত বিএল কলেজে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স কোর্স নিলাম। ভঙ্গুর মন নিয়েই পরবর্তী বছরে পুনরায় ভর্তি পরীক্ষা যুদ্ধ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি মেধা তালিকায় আর খুলনা বিশ্ববিদ্যলয়ের অপেক্ষমান তালিকায় সুযোগ পেলাম।
অনেকটা লটারির মতোই প্রথম পছন্দ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলেও তৎকালীন সহিংস ছাত্র রাজনীতির প্রেক্ষাপটে একমাত্র ছেলে সন্তান হিসেবে আমার পিতা আমাকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার জন্য পরামর্শ দিলেন। যদিও আমার ইচ্ছে ছিলো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করবো, বাম ধারার ছাত্র রাজনীতি, গ্রুপ থিয়েটার, গানের দল এইসব এক্সট্রা কারিকুলামের সাথে নিজেকে যুক্ত করবো। কিন্তু চূড়ান্তভাবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্র জীবন একেবারেই নির্জীব সরীসৃপের মতো হয়ে পড়লো! কেননা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় তখন কেবলই হাটিহাটি পা পা করে দুইটি ব্যাচ নিয়ে পথচলা আরম্ভ করেছে। আমি তৃতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে ছয়টি ডিসিপ্লিনের (সাবজেক্টের) ১৮০ জনের একজন হয়ে গেলাম। শুরুর পর্যায়ে আমরা বলতাম খুলনা কিন্ডারগার্টেন, আমাদের নিয়মিত ক্লাস আরম্ভ হলো দোচালা টিনের ঘরে।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন “ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার” হিসেবে শুরু হলেও কোথায় যেন একটা প্রশান্তির অনুভূতি তাড়িত করতো। পরবর্তীতে খেয়াল করেছি আমার মতো সবাইকেই সেই ভালো লাগার অনুভূতি আপ্লূত করতো শুধুমাত্র অন্যতম একটি কারনে। আশা করি সেটা সহজে অনুমেয়, একমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আইন করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র রাজনীতিমুক্ত হিসেবে যাত্রা আরম্ভ করে আজ অবধি সেই ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে দেশের সব ক্যাম্পাসে সেই সময়ে ছাত্র রাজনীতির বিষাক্ত ছোবলে শিক্ষার্থীরা দিশেহারা, নিয়মিত কোন্দলে জড়িয়ে নিজেদের মধ্যে অস্ত্র যুদ্ধ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটত সেখানে আমরা এক মুক্ত বিহঙ্গের মতো ছোট্ট অগোছালো ক্যাম্পাস জুড়ে নির্ভয়ে চরে বেড়াতাম। আমাদের ক্যাম্পাসে তখন ছাত্র বা ছাত্রী হল পর্যন্ত ছিলো না। শহরের ভাড়া করা হলে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করতো, একটিমাত্র বাসে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীদের বহন করে নিয়ে আসতো। সেই যে একসাথে ভ্রমণের, সহবস্থানের কালচার তৈরি হলো সেটি বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের ইতিহাস নতুন করে লেখার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
ছাত্র রাজনীতি যুক্ত ক্যাম্পাসের অনেকের মধ্যেই কৌতূহল- রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের আচার আচরণ ব্যবহার কেমন হয়? আসলেই কি ছাত্র রাজনীতি পরিহার করে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব? আমাদের ছোট্ট খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়াতেই সিনিয়র জুনিয়রদের একইসাথে বসে আড্ডা, নির্বিশেষে ধুমপান, কোন দলাদলি নেই, নির্মল হাসি আনন্দ আর লেখাপড়া নিয়ে ব্যাপক একাডেমিক চাপ। যে বা যারা লেখাপড়া নিয়ে একটু রিলাক্স মুডে ছিলো তারাই প্রথম সেমিস্টারে ডাব্বা মেরে হুশ ফিরে পেয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য কো-কারিকুলামের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অগ্রাধিকার লেখাপড়া, পরিবেশটা ছিলো একটা পরিবারের মতো। লেখাপড়ার চাপ একটু বেশী থাকাতে অনেক স্বাধীনচেতা শিক্ষার্থীরা বলতো এ কোন কিন্ডারগার্টেনে এসে পড়লাম রে বাবা? কিন্তু পারস্পারিক সম্পর্কের জায়গায় যে আস্থা এবং সমঝোতার চমৎকার একটা পরিবেশ পেয়েছি তা সবার জন্য এক অনাবিল প্রশান্তির জায়গা হিসেবে পবিত্র অনুভব তৈরি করেছে। বিশেষতঃ ক্যাম্পাসের সিনিয়র জুনিয়র মধুর সম্পর্ক এক কথায় অনবদ্য মাত্রা সৃষ্টি করেছিলো।
তাহলে যারা ন্যাচারাল লিডার তাদের বিকশিত হবার কি কোন পথ খোলা ছিলো খুবি ক্যাম্পাসে? যারা কিছুটা প্রো-একটিভ চরিত্রের ছিলো, তাদের আচরণে ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস কি জাতীয় প্রভাব ফেলেছিলো? আমাদের ক্যাম্পাসেও কিন্তু অন্যান্য ক্যাম্পাসের মত বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসের শিক্ষার্থী ছিলো, তখন বিএনপি ক্ষমতায় থাকায় অনেকেই সেই ধারায় সম্পৃক্তও ছিলো। কিন্তু আধিপত্য ও প্রভাব প্রতিপত্তি খাটানোর কোন জায়গা না থাকায় তারাও কিন্তু নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত হয়েছিলো। আমাদের বন্ধুদের মধ্যেই কয়েকজনের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত বলতে পারি রাজনীতির সুযোগ পেলে তারা সবাই অস্ত্রধারী ক্যাডার হতো। ক্যাম্পাসে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েও পড়তো, অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনাতিতে ক্যাম্পাস হতো রক্তাক্ত। শুধুমাত্র ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার কারনেই আমাদের ক্যাম্পাসের কোন শিক্ষার্থীই খুব বড় ধরণের অন্যায় বা সংঘর্ষের সাথে কোনদিন জড়িত হবার সুযোগই পায়নি। একইসাথে কোন্দলমুক্ত পরিবেশের কারনে সবাই নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারতো, ফলে এই বিষয়টি যার যার অন্তর্নিহিত মেধা বিকাশের সর্বোচ্চ সুযোগ করে দেয়।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply