বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন, ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় কেন অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে গেলো?
সমগ্র দেশের অন্যান্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে পুরোপুরি উল্টো পথে কিভাবে হাটতে পারলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আপামর শিক্ষার্থীরা? এই যে দীর্ঘ পথচলা সেখানে কি কোন আগ্রহী পক্ষ ছিলো না যাদের খুবি’তে ছাত্র রাজনীতি ঢুকিয়ে দেয়ার কামনা বাসনা ছিলো না? অবশ্যই ছিলো, আমাদের সময়েই (১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭) দেখেছি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ভাই ব্রাদারদের ক্যাম্পাসে পদচারণা। আমাদের মধ্যেই কারো কারো বন্ধু সেজে ওনারা এসেছেন, হাওয়া বুঝতে চেষ্টা করেছেন এমনকি ছাত্র হল ভিত্তিক ছায়া কমিটিও গঠন করেছেন বলে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওয়াকিবহাল ছিলাম।
এখন বুঝতে হবে আমাদের খুবি’র প্রথম ব্যাচ কেন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি না করার এমন একটি উল্টো শপথ নিয়েছিলো? কারণ তখন থেকেই সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের মাঝে প্রচলিত দলীয় লেজুরভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির কুফল নিয়ে বিক্ষুব্ধতা জন্ম নিতে শুরু করেছিলো অনেকগুলো ব্যবহারিক কারনে। একটু দেখে নিই আমরা কেন ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলাম সেই ১৯৯০ সালে:
আফসোসের বিষয় হলো ১৯৯০ সালের পর চৌত্রিশ বছর পার হলেও বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির চরিত্রের কোন পরিবর্তন তো হয়ইনি উল্টো অব্যাহত আছে এবং আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা একেকজন মাফিয়া সর্দার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ব্যতীত বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন নির্মূল করে দেয়ার বর্বর সংষ্কৃতি এখন প্রতিষ্ঠিত। সেই প্রেক্ষাপটে আমরা যদি নব্বইয়ের গণআন্দোলন পরবর্তী বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির গ্রাফ লক্ষ্য করি তা অবনমনের শেষ বিন্দু স্পর্ষ করেছে এ বিষয়টি এক কথায় মেনে নিতে দেশের কোন বিবেকবান মানুষের আপত্তি থাকবে না।
তাহলে তো প্রমাণিত হয়েই গেলো ছাত্র রাজনীতিমুক্ত থাকার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের নেয়া সিদ্ধান্তটির যৌক্তিকতা। আসলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টিকারী ছাত্র রাজনীতি যেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কল্যাণের প্লাটফর্ম হিসেবে দাঁড়াবার কথা সেটি হয়ে গেলো সীমাহীন নিবর্তনমূলক এক বিভীষিকাময় মঞ্চ। সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের পক্ষে এখন আর ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হবার মতো কোন পরিবেশই অবশিষ্ট নেই। এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই ঘুরে দাড়ানোর বিকল্প নেই, কিন্তু ঘুরে দাঁড়াবার জন্য যে সমর্থন বা নেতৃত্ব প্রয়োজন খুব সচেতনভাবেই রাজনীতির সিনিয়র খেলোয়াড়গণ হতে দেয়নি।
গত ৭ এপ্রিল ২০২৪ একটি জাতীয় দৈনিকে “খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প” শিরোনামে লেখাটিতে চমৎকার কিছু অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন। এক নজরে তার কিছু অংশ দেখে নিই-
“বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যাকে মডেল হিসেবে ধরা যায়, তার নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। হয়তো সেটা ছাত্ররাজনীতি না থাকার জন্যই হবে। কারণ, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেবল এটিই। এ ছাড়া অনেক বিষয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার জায়গা আছে। তা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে না হয়তো। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ৩৪ বছরে পদার্পণ করেছে, সুদীর্ঘ এই সময়ে রক্তপাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। উপরোক্ত এ বাক্যটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তির তা নয়, অভিভাবকদের জন্য কতটা স্বস্তির ব্যাপার, তা অনুমেয়। কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলো দুই দশক ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশই নেতিবাচক শিরোনাম হয়ে একটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সেই জায়গা থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই অনন্য মডেল।”
অন্যদিকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী কিভাবে ছাত্র রাজনীতিমুক্ত হবার শপথ নিয়েছিলেন তার ফেসবুক পোস্টে সেই ইতিহাস তুলে ধরেছিলেন এইভাবে-
যেভাবে ছাত্ররাজনীতি মুক্ত হল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়-
৩১ আগষ্ট, ১৯৯১ ক্লাস শুরুর পর আমরা প্রথম ব্যাচের ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়তাম যখন ক্লাসের ফাঁকে গোলপাতার ছাউনি বিশিষ্ট ক্যান্টিনে যেতাম। কিংবা ক্লাসের ফাঁকে বারান্দায়/নিচে দাঁড়িয়ে নতুন বন্ধুরা আড্ডায় মেতে উঠতাম। ঝাঁকে ঝাঁকে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা ছুটে আসত আমাদের আড্ডার মাঝে। রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে আমাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত। আমাদেরকে তাদের দলে টানার চেষ্টায় সবরকম কৌশল অবলম্বন করত। আমরা মনখুলে বন্ধুদের সাথে কথা বলারই সুযোগ পেতাম না। তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটাই মাত্র ভবন ছিল। দোতলায় ক্লাস রুমের পাশে সিনেট রুম ও ভিসি স্যারের রুম ছিল। আমরা প্রায় ৪০জন ছাত্র ঐ সিনেট রুমেই থাকতাম। একরুমে এতজন তবু কোন কষ্টই মনে হয়নি আমাদের। খুব আনন্দ ফুর্তির মধ্যেই কেটে যেত আমাদের সময়। বহিরাগতদের অযাচিত মেলামেশা ও রাজনৈতিক দলে টানার চেষ্টায় সবাই বিব্রত হতাম। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সিনেট রুমবাসী ২৫/৩০ জন ছাত্র একদিন বিকালে বসে গেলাম আলোচনায়। একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হল আমরা যে মতেরই হই না কেন ক্যাম্পাসে কোন রাজনীতি করব না। সবাই একমত হয়ে হাততালি দিয়ে উল্লাস করতে লাগলাম। আমাদের হাততালির শব্দ শুনে পাশের রুমে বসে থাকা ভিসি স্যার (প্রফেসর ড. গোলাম রহমান) ক্ষিপ্ত হয়ে ছুটে এলেন এবং আমাদের বকতে শুরু করলেন। আমাদের একবন্ধু স্যারকে বুঝিয়ে বলতেই উনি খুব খুশি হলেন এবং ছাত্রদের সাথে ঐক্যমত পোষন করে বক্তব্য দিলেন। পরদিন এই খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। খুলনার বহুলপ্রচলিত দৈনিক পুর্বাঞ্চলসহ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হল। এরপর থেকে আর কোন বহিরাগত আমাদের ক্যম্পাসে আসত না। প্রথম ব্যাচের ৮০ জন ছাত্রছাত্রীরা সবাই এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত ছিল। শুরু হল ছাত্র রাজনীতিমুক্ত অবস্থায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা।
এ,জেড,এম আনোয়ারুজ্জামান
প্রথম ব্যাচ
কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিন,
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply