রাস্তায় দুই দল কুকুরের মধ্যে যুদ্ধ (ডগ ফাইট) যদি আমরা কেউ দেখে থাকি তাহলে যে কারো পক্ষে বাংলাদেশের রাজনীতির প্রকৃত চিত্রটা সহজেই অনুমান করা সম্ভব। আমি আমার দেখা গত চৌত্রিশ বছরের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ এরচেয়ে ভালো ভাষায় আর করতে পারছি না। ধারাবাহিকভাবে এক দলকে ধ্বংস করতে অন্য দলের সে যে কি ভয়ংকর রাজনীতি রাজনীতি খেলা তাকে কোনভাবেই সভ্য সমাজের অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করার সুযোগ নেই। দলান্ধতা কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি এই দেশের মানুষ তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে আসছে বোধহয় সেই ১৯৭২ সাল থেকেই। যদিও আমি আমার দেখা অংশের অভিজ্ঞতাই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। কারণ তৎপূর্ব রাজনীতির ইতিহাস নিয়ে এতো বেশী বিভক্তি, এতো বেশী তথ্য বিভ্রাট যে শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা হবে একজন নিরপেক্ষ দৃষ্টির মানুষের জন্য। আপনি এক পক্ষের কথা শুনে ভাবতে বাধ্য হবেন এই পক্ষই সঠিক আবার অন্য পক্ষের কথা শুনে মনে হবে তাই তো, এদের কথায়ও যুক্তি আছে!
তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সুযোগ পেয়ে ছাত্র রাজনীতির ডগ ফাইট আমাকে দেখতে হয়নি বলে নিজেকে ধন্য মনে করি। এমন বেআক্কেল হুজুগে আমরা যে রাজনীতিকে সমর্থন করি সেই রাজনৈতিক দলের কোন একটি কাজের ভুল ধরা মহাপাপ হিসেবে গণ্য করি। আমার নিজের সমর্থনের দল যা কিছু করে সবকিছু হালাল আর বিরোধী পক্ষের লোকেদের সব কর্মকান্ড হারাম বা কবিরা গুনাহের সমতূল্য যেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি দুটি কারনে, প্রথমত আমার ভয়ঙ্কর ইংরেজি ভীতি দূর করতে ভূমিকা রাখায় আর দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের প্রচলিত কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থনের অন্ধত্ব থেকে মুক্ত রাখার জন্য। যে মানুষগুলো দলান্ধ তাদের না আমার কাছে স্রেফ দাস মনে হয়, তাদের জন্য বড্ড করুনা হয়, আমি এদের দলাদলিতে লিপ্ত হবার যুক্তি তর্কগুলোকে পুরোপুরি ঘেউ ঘেউ হিসেবে বিবেচনা করি। আমার শব্দ চয়নের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ আমি অন্যের মতামতের প্রতি অবশ্যই শ্রদ্ধাশীল।
আমার কথা হলো- বলুক না যার যার কথা তার মতো করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে, সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত করে। বলতে দাও, বাঁধা উন্মুক্ত করে যার যার মনের আকূলতা প্রকাশ করতে দিলে কি খুব বেশী ক্ষতি হয় কারো? না, এদেশে সে সুযোগ নেই। যে দল রাস্ট্র ক্ষমতায় আছে শুধু তাদের গুনগান গাইতে না পারলে আপনি ভীষণ অযোগ্য, অদক্ষ, অচল মানুষ। ন্যায্য কথা বলেছেন তো আপনার মুণ্ডুপাত হবে অথবা মুখ বন্ধ করে দেয়ার জন্য রাস্ট্রীয়ভাবে টুঁটি চেপে ধরার আইনকানুন তৈরি করা হবে। একজন সরকারী আমলার সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ নেই কোন অবস্থাতেই, এটি এক অলিখিত অনিয়ম বাংলাদেশে। অপরদিকে দলীয় সংসদ সদস্য নিজের দলের সিদ্ধান্ত বা আইনের বিপক্ষে ভোট না দেয়ার লিখিত আইন করা হয়েছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উদ্দেশ্যে। এইসব প্রথা বা আইনকে আপনি এক কথায় মগের মুল্লুকের আইন হিসেবে আখ্যা দিতে পারেন অনায়াসে।
আমি যদি এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে বিপুল আশাবাদ নিয়ে রাস্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত বেগম খালেদা জিয়ার শাসন আমলের ভালো মন্দ সবদিকের প্রসঙ্গ নিয়েই সুনির্দিষ্ট তথ্য ভিত্তিক আলোচনা করি সেখানে কিন্তু সেই সরকার মন্দ কিছু করেছিলো তার অকাট্য প্রমাণও হাজির করি তবুও সেই কথা বিএনপি সমর্থক একটি মানুষকেও বিশ্বাস করাতে পারবেন না। বলা হয় মোনাফেকদের হৃদয়ে আল্লাহ সিল মেরে দেন, আমার কাছে কট্টর আওয়ামীলীগ ও বিএনপি সমর্থকদের সেই অভিশপ্ত সিল মারা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত মনে হয়। একই দেশের জল হাওয়ায় জন্ম, একই মাটিতে উৎপাদিত খাদ্য শস্য ভক্ষণ করেও কিভাবে এমন জিঘাংসাপূর্ন সম্পর্ক হতে পারে ভিন্ন দলের সমর্থক হবার কারনে তার খুব সহজ ব্যাখ্যা আমার কাছে আছে। আসল কথাটা আমার এই ধারাবাহিক লেখার শিরোনামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে- সুবিধাবাদ জিন্দাবাদ। মূল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব জনগণের উপর নিজেদের কতৃত্ব বজায় রাখতে এমন বিতর্কগুলো উসকে দিয়ে "মজা মারে ফজা ভাই আমরা শুধু বৈঠা বাই"।
ছলে বলে কলে কৌশলে যেকোন উপায়ে রাস্ট্র ক্ষমতাকে ধরে রাখার এক উদগ্র আকাঙ্ক্ষার প্রতি সীমাহীন লোভ লালসার বসবর্তী হয়ে সব রাজনৈতিক দল দেশের জনগনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে যান শুধু। উদ্দেশ্য একটাই, আমিই শুধু রাস্ট্র ক্ষমতায় থাকবো, যাবতীয় অবৈধ সুযোগ সুবিধা ভোগ করবো, জনগণের নাম ভাঙ্গিয়ে চুরি বাটপারি চালিয়ে যাবো লুটপাটতন্ত্র চালিয়ে যাবো। বন্যা, সাইক্লোন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে পূঁজি করে রিলিফের সামগ্রী বা টাকা চেয়ারম্যান, মেম্বর ও দলের নামে আত্মসাৎ করে যাবো বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। চেয়ারের মানুষ বদলাবে কিন্তু চুরি ডাকাতির পদ্ধতি বদলাবে না। আমি খুবই কষ্ট ও হতাশা নিয়ে বিএনপির (১৯৯১ থেকে ১৯৯৫) শাসনামল লক্ষ্য করেছিলাম। এরশাদের আমলে বিটিভি ছিলো সাহেব বিবি গোলামের বাক্স আর বিএনপির সময় পরিণত হয়েছিলো বিএনপি টিভিতে। পুরো শাসনামলে বিটিভি জুড়ে এক তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমূল হুদার বয়ান, উন্নয়নের দুধের নহর, ডাল ভাত কর্মসূচী, শহীদ জিয়া ছাড়া বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কারো স্থান আমরা দেখতে পাইনি সেদিন।
একটি একান্ত ব্যক্তিগত গোপন তথ্য ফাঁস না করলে আমার কষ্টের বিষয়টি বোধকরি সকলে হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ হবেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে আপোষহীন নেতৃত্ব গুণে বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন তরুণদের মধ্যে এক অনন্য ক্রেজ তৈরি করেছিলেন। তাই জীবনের প্রথম ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়ে আমি ধানের শীষ মার্কাই বেছে নিয়েছিলাম! আমার কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য বা আকাঙ্ক্ষা ছিলো দলটির প্রতি তা একটু পয়েন্ট আকারে উপস্থাপন করতে চাই-
আমার তরুন বয়সে আকাঙ্ক্ষিত উপরের চাহিদাগুলোর একটিও কি মেটাতে পেরেছিলো নব্বুইয়ের গণআন্দোলণ পরবর্তী পরম নিরপেক্ষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা দলটি?
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।