এই ধারাবাহিক রচনাটির সর্বশেষ পর্ব অর্থাৎ গত পঞ্চম পর্বে এরশাদ আমলের নয় বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর পরবর্তী সরকারের নিকট আমার ব্যক্তিগত কিছু আকাঙ্ক্ষার তালিকা উল্লেখ করেছিলাম। সেই তালিকায় অন্যতম চাওয়া ছিল "ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানে হওয়া নির্বাচনে বিরোধী দলের ক্ষমতায় যাবার সুযোগ থাকবে। অর্থাৎ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্থায়ী বন্দোবস্ত সৃষ্টি হবে।" এই আকাঙ্ক্ষা তৈরি হবার উৎস্য ছিল পশ্চিমা গণতন্ত্রের মডেল এবং অবশ্যই প্রতিবেশী দেশ ভারতের রাজনৈতিক ঐতিহ্য। দলমতের হাজারো ভিন্নতা থাকলেও দেশের জনগণ তথা ভোটারগণ পাঁচ বছর পরপর স্বাধীনভাবে নিজেদের মতামত অনুযায়ী অবাধে পছন্দের দল বা ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে দেশের সরকার গঠন করতে পারবে।
আমার পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অতিবাহিত হয়েছে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি এর শাসনামল পর্যবেক্ষণ করে। যদিও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে কোন ধরণের রাজনীতির সাথে যুক্ত হবার সুযোগ ছিল না এবং আমার তৎকালীন সহিংস ছাত্র রাজনীতি নিয়ে চরম বিতৃষ্ণা ছিল তাই জীবনের প্রথম ভোট দেয়া দল বিএনপির কাছে প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তির বিষয়ে নজর রেখেছিলাম। আমাদের ছোট্ট ক্যাম্পাসেই নতুন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেলেন ডঃ গোলাম আলী ফকির স্যার যিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত উদ্ভিদ রোগ তত্ত্ববিদ। আমাদের প্রথম উপাচার্য ডঃ গোলাম রহমান স্যারকে অল্প কিছুদিন পেয়েছিলাম তাই স্যারের খুব বেশি সান্নিধ্যে যাবার সুযোগ পাইনি। সেক্ষেত্রে ফকির স্যারের বিএনপিমনা আদর্শের কিছু কার্মকান্ড চোখে পড়তো যদিও তা খুব বেশি প্রকট ছিল না। আমরা যাবতীয় সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ড নির্বিঘ্নেই বাস্তবায়ন করেছি, প্রত্যেক বছর ক্যাম্পাসে স্বরসতী পূজায় হিন্দু বন্ধুদের সাথে আয়োজনে যুক্ত থেকেছি।
তবে আমাদের জন্য তখন সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ হয়ে বটবৃক্ষের মত ক্যাম্পাসকে রাজনীতির কালো ছায়া থেকে মুক্ত করতে সদা তৎপর ছিলেন বিএনপির প্রয়াত মেয়র জনাব তৈয়েবুর রহমান চাচা। ওনাকে চাচা বলছি এই কারনে যে সৌভাগ্যবসতঃ তাঁর একমাত্র ছেলে আমাদেরই সহপাঠি ছিল। বন্ধুটির মাধ্যমে আমাদের সব ধরণের অভাব অভিযোগ সহজেই চাচার কাছে পৌঁছে দেয়ার সুযোগ ছিল। যখুনি আমরা খুলনার নিরালার হাজী বাড়ির মাস্তান গুন্ডাদের বিভিন্ন হয়রানির শিকার হয়েছি তখুনি মেয়র সাহেবের প্রভাবে আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ঝুট ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়েছি। তিনি এতোটাই বড় মনের মানুষ ছিলেন যে খুলনার স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী মানুষদের অব্যাহত উস্কানির মুখেও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি প্রবেশ করতে প্রবলভাবে বাঁধা দিয়েছেন।
এবার আসি আমজনতা বা একজন অরাজনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার রাজনৈতিক প্রত্যাশার বিশ্লেষণে। এরশাদ আমল পর্যন্ত আমাদের দেশে যেহেতু প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং সেই পদ্ধতি একজন ব্যক্তিকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে ফেলতো তাই দেশের আপামর জনসাধারণের দাবি ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একজনের স্বৈরাচার হয়ে ওঠার ব্যবস্থাকে চিরতরে নির্মূল করা। সেই আকাঙ্ক্ষার প্রাপ্তি ঘটিয়ে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের পাঁচ বছরের শাসনামলে এটিই ছিল শ্রেষ্ঠ ঘটনা।
উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন
এই পর্বে খালেদা জিয়া সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বা উপনির্বাচন নিয়ে সংঘটিত কিছু ইতিহাস www.bdarchive.com এর পেজ হতে তুলে ধরলাম-
১৯৯১ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদ সরকারের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফলাফল অনেককেই বিস্মিত করে। কেননা, আওয়ামী লীগ যেখানে সুসংগঠিত ও ঐতিহ্যবাহী একটি রাজনৈতিক দল, সেখানে বিএনপি তখনো সাংগঠনিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও অগোছালো ছিল। ‘সূক্ষ্ম কারচুপি ও আঁতাতের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নিশ্চিত বিজয়কে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে’ বলে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা দাবি করেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগবিরোধী সকল শক্তি যে ঐক্যবদ্ধ হয়, তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষ করে, বিএনপি ও জামায়াতের নির্বাচনী সমঝোতা ছিল খুবই সুস্পষ্ট। নির্বাচনী ফলাফলেও তা প্রতিফলিত হয়।
যাহোক, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বহু বছর পর এই প্রথম বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু ও কার্যকর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেয়। আসলে আওয়ামী লীগের বিরোধিতায় সকল দক্ষিণপন্থী শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি এরশাদবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার ‘আপসহীন নেত্রী’র যে ইমেজ গড়ে ওঠে, তা বিএনপির নির্বাচনে জয়ী হতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। ১৯শে মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। পরদিন খালেদা জিয়া ৩২ সদস্যবিশিষ্ট একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
১৯৯১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের ১১টি শূন্য আসনে (একাধিক আসনে বিজয়ী সদস্যদের অতিরিক্ত আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণে) উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, নির্বাচনে সরকারি প্রভাব খাটানোর মতো ঘটনা ঘটে, যা বিএনপি সরকারের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করে। ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে সংসদের প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ও অন্যরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। এর ওপর ১২ই আগস্ট অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে বিএনপি ১৬৮-১১২ ভোটে জয়ী হলেও (উভয় পক্ষের অনেকে নানা কারণে উপস্থিত থাকতে পারে নি), সরকারের জন্য এটি ছিল একরূপ রাজনৈতিক ধাক্কা।
এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ঢাকার মিরপুরের উপনির্বাচন এসে উপস্থিত হয়। বিএনপি সাংসদের মৃত্যুজনিত কারণে এ আসন শূন্য হয়। ১৯৯৩ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত এ উপনির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হন। নির্বাচন শেষে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল আওয়ামী লীগ সরকারি হস্তক্ষেপে নির্বাচনী রায় সরকারি দলের পক্ষে উল্টে দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ উত্থাপন করে। প্রতিবাদস্বরূপ আওয়ামী লীগের আহ্বানে ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল পালিত হয়। এই উপনির্বাচনে সরকারের অবস্থান নিরপেক্ষ ছিল, এ কথা আদৌ বলা যাবে না। ১৯৯৪ সালের ৩০শে জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচনে সরকারদলীয় প্রার্থী হেরে গেলে এর প্রতিশোধে সংঘটিত হয় লালবাগ হত্যাকাণ্ড ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনে ১৯৯৪ সালের ২০শে মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন ছিল একটি মোড়ফেরানো ঘটনা। দীর্ঘদিন ধরে এটি ছিল আওয়ামী লীগের আসন। ১৯৯১-এর নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী এখানে জয়ী হন। আওয়ামী লীগ সাংসদের মৃত্যু হলে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি ফলাফল অনুযায়ী নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়ী হন। সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাপক কারচুপি, সন্ত্রাস ও অনিয়ম ঘটে। এরপর আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বিরোধী দলের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস ও উপলব্ধি জন্মে যে, বিএনপি সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। তাই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা জোরালোভাবে সম্মুখে নিয়ে আসে।
তাদের মূল দাবি : জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে দলীয় সরকারের পদত্যাগ এবং তদস্থলে গঠিত একটি নিরপেক্ষ, নির্দলীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান। অন্তত তিন-চার টার্মের জন্য এরূপ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকা। এ লক্ষ্যে বিরোধী দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে একটি বিল উত্থাপনেরও চেষ্টা হয়। কিন্তু সরকারি দল কিছুতেই এ বিষয়ে সম্মত ছিল না। মাগুরা উপনির্বাচনের পর বিরোধী দলসমূহ ভবিষ্যতে কোনো উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৯৪ সালের ৩০শে মার্চ থেকে একটানা সংসদ বর্জন শেষে একই বছর ২৮শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ বিরোধী দলের ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে তাঁদের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। এটি ছিল একটি নজিরবিহীন ঘটনা।
তথ্য সূত্র: https://www.bdarchive.com/%E0%A6%96%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2/
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।