১৯৯৪ সালের ২০শে মার্চ অনুষ্ঠিত মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচন:
দূর্ভাগ্যবশতঃ আমার গ্রামের বাড়ি মাগুরা-২ আসনের অন্তর্গত! দূর্ভাগ্য এই জন্য বলছি যে, একটি কালিমা লিপ্ত উদাহরণ হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এবং নির্বাচনের ইতিহাসে দীর্ঘদিন ধরে কুখ্যাতি বহন করতে হবে আমাদের। এছাড়া উক্ত মাগুরা-২ আসনের নির্বাচনের কালো অধ্যায়ের সাথে আমারও কিঞ্চিৎ সম্পৃক্ততা ছিলো! কারণ তখন আমি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, একানব্বইয়ের নির্বাচনে ধানের শীষের পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম, তখনো খালেদা জিয়া প্রীতি পুরোপুরি শেষ হয়নি। সেই কারণে আমাদের আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়া আমার গ্রাম থেকে মাত্র দুই আড়াই কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বামনখালী গ্রামের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইকোনো বলপেন খ্যাত কাজী সালিমুল হক কামাল ভাইকে এক বাক্যে সমর্থন জানিয়েছিলাম।
শুধু সমর্থন নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পরীক্ষা বাদ দিয়ে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে (নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত) শালিখা থেকে শুরু করে হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত প্রতিটি গ্রামে গ্রামে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কামাল ভাইয়ের জন্য ভোট চেয়েছিলাম। আমাদের মাগুরা-২ আসনটি আওয়ামীলীগ এর প্রয়াত সাংসদ আসাদুজ্জামান সাহেবের স্থায়ী আসন হিসেবে বিবেচিত হতো মূলত হিন্দু জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকার মানুষের একচেটিয়া ভোট থাকার কারণে। সেই ব্যাপারটা উপলব্ধি করেই আমরা গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মিলে সংগোপনে কোনরকম স্বার্থ ছাড়াই, বিএনপি নেতাদের সাথে কোন যোগাযোগ না করেই কামাল ভাইয়ের পক্ষে ভোট চেয়েছিলাম রাত বিরাতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে।
যদিও আমার একজন সুহৃদ খুব কঠোরভাবেই নিষেধ করেছিলো কামাল ভাইয়ের পক্ষে কাজ না করতে। তার ভাষ্য ছিলো আমাদের এলাকাটা প্রত্যন্ত বিধায় এখানকার মানুষ খুব সহজ সরল, এই প্রত্যন্ত এলাকা থেকে একজন সাংসদ নির্বাচিত হলে এলাকার মানুষ নষ্ট রাজনৈতিক ধারার সাথে যুক্ত হয়ে পড়বে। অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের বিস্তার ঘটে এলাকার যুবক শ্রেণী ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। তখন আমি তর্কের খাতিরে বলেছিলাম যে, আমাদের এলাকার রাস্তাঘাট ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। প্রয়াত সাংসদ আসাদুজ্জামানকে আমরা আজীবন বাক্স ভরে ভোট দিয়েছি কিন্তু তিনি আমাদের এলাকার উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রাখেননি। এইবার কাজী কামাল ভাইকে জয়ী করে আমাদের এলাকার উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সেই সুহৃদ বলেছিলো- তুমি ভুল করছো, এলাকায় সর্বানাশের বীজ বপন করতে একটা অন্যায্য কর্মকান্ডে যুক্ত হয়েছো, তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি।
সেই সুহৃদের নীতিবাক্য সেদিন মেনে না নিয়ে কাজী কামাল ভাইয়ের পক্ষে গোপনে গণসংযোগের কাজ চালিয়ে যাই আমরা এলাকার কয়েকজন যুবক মিলে। আমাদের সেই গোপন নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের সারমর্ম ছিলো যে, কাজী কামাল ভাইয়ের জয়ের সম্ভাবনা স্পষ্ট কারণ হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ গোপনে ধানের শীষে ভোট দিতে চান। তবে তারা প্রকাশ্যে বলতে পারছেন না কারণ ১৯৭১ সালের পর থেকেই সবাই নৌকা মার্কায় ভোট দিতে অভ্যস্ত। আমরা তাদের যুবক প্রতিনিধিদের কাছে গিয়ে বলি একবার একটু পরিবর্তন করে দেখেন। কাজী কামাল ভাই তো আওয়ামীলীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন, পাননি বলেই বিএনপি থেকে নির্বাচন করছেন। ওনার মূল লক্ষ্য দল নয়, এলাকার উন্নয়ন, আপনারা তাঁকে একটিবার সুযোগ দিয়ে দেখেন।
কাজী কামাল ভাইয়ের পক্ষে গোপন নির্বাচনী প্রচার শেষ করে নির্বাচনের আগের দিন ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। আমি গ্রামের ভোটার ছিলাম না তাই ভোট দেয়ার সুযোগ ছিলো না। নির্বাচনের দিন দুরুদুরু বুকে খানজাহান আলী হলে অপেক্ষা করছিলাম, তখন তো আর মোবাইল ফোনের চলন ছিলো না তাই সংবাদপত্র, রেডিওর খবর, বিবিসি নিউজ, ভয়েস অফ আমেরিকার উপর নির্ভর করতে হতো। নির্বাচনী প্রচারণার শেষদিন বন্ধুদের বলে এসেছিলাম আমরা নির্বাচনে জয়ী হবো ইনশাআল্লাহ, কোনভাবেই যেন কারচুপির চেষ্টা না করা হয়। বিশেষ করে হিন্দু ভোটারদের যেন ভয় ভীতি না দেখানো হয়, নির্বাচনের আগের রাতে যেন টাকা ছড়ানো না হয়! কারন ইতিপূর্বে খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত উপনির্বাচনগুলো অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। মোসাদ্দেক হোসেন ফালু সাহেবকে কিভাবে জোর করে উপনির্বাচনে জিতিয়ে আনা হয়েছিলো সেই অবস্থা মাগুরা উপনির্বাচনেও হোক তা আমি কখনোই চাইনি।
কিন্তু ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় বিবিসি ও ভয়েস অফ আমেরিকার নিউজ থেকে মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে ব্যাপক ভোট ডাকাতি ও কারচুপির খবর জানলাম। পরদিন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদ ও ভোট ডাকাতির চিত্র দেখে কাজী কামাল ভাইকে জয়ী করা হয়েছে জেনেও এতোটাই হতাশ হয়েছিলাম যে ঐদিন থেকেই আমার মনের ভিতর থেকে বিএনপি প্রেমের চির অবসান ঘটে গেলো। আমার সেই সুহৃদের উপদেশ না শুনে যে মহা অন্যায় করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্য ইহজীবনে আর করার সুযোগ পাবো না। কারণ পরবর্তী সময়ে আমাদের এলাকায় আসলেই অবৈধ অস্ত্র ও মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিলো। আমাদের অতি পরিচিত জুনিয়র ছেলেরা কেমন উগ্র চলাফেরা আরম্ভ করেছিলো তা চোখের সামনেই দেখা যেত। কামাল ভাই এলাকার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন বটে কিন্তু নষ্ট ধারার রাজনীতির স্থায়ী বীজ বপন করে একটি জ্ঞানভিত্তিক আলোকিত এলাকাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিলেন।
মাগুরা-২ আসনের স্থায়ী বাসিন্দা আমার স্কুল জীবনে প্রয়াত প্রধান শিক্ষক শেখ শামসুর রহমান স্যারের আদর্শের কারণে বাম ধারার রাজনীতির প্রতি প্রাথমিক আসক্তি তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু কলেজ জীবনে বিএল কলেজ শাখা ইসলামী ছাত্র শিবিরের পরিচ্ছন্ন রাজনীতির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলাম। আর সর্বশেষ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সুবাদে ক্যাম্পাসের নিরপেক্ষ রাজনৈতিক পরিবেশ আমাকে ধীরে ধীরে প্রগতিবাদী নিরপেক্ষ চিন্তার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলো। স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার মনন ও চিন্তায় এইরকম ধারাবাহিক রাজনৈতিক রূপান্তর আমাকে কোন ব্যক্তি বা দলের প্রতি অন্ধ ভক্তি থেকে মুক্ত করেছিলো। আমি একজন মুক্তমনা মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পেরেছিলাম শুধুমাত্র খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজনৈতিক পরিবেশের ছোঁয়ায়। এজন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে যারা ছাত্র রাজনীতি মুক্ত রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।