বাংলাদেশের নির্বাচনী সংষ্কৃতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয় ভাসমান ভোটারদের মনোভাব। কারণ দেশের দুই প্রধান দলের মোটামুটি সংরক্ষিত বা রিজার্ভ ভোট প্রায় সমান সমান। তাই অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট দেয়ার সুযোগ থাকলে কোন দল যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে ক্ষমতায় বসতে পারবে তার নিশ্চয়তা দেয়া সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিএনপি-আওয়ামীলীগ ঘরানার দলগুলোর জন্য কঠিনতম আর একটি অসুবিধা হলো এ দেশের বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যার কোন অন্ত নেই। বাস্তবে কোনভাবেই কোন সরকারের পক্ষে সব শ্রেণীর মানুষকে খুশি করা সম্ভব নয়। ফলাফল তাই অনির্ধারিত, সরকারে থেকে যে দলই হাজারো ভালো কাজ বা উন্নয়ন করুক ভাসমান ভোটারদের মন জয় করে নিজেদের পক্ষে ভোট নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব! কারণ এদেশের রাজনীতিকরা দুর্নীতি করবে না, দলীয় লোক বা আত্মীয়দের সুবিধা দেবে না এমনটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
আশি সালের দিকেও আমাদের গ্রামের এলাকাসহ আশেপাশের অন্যান্য এলাকায় দেখেছি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খুবই সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কোন নির্দিষ্ট দলের ছিলেন বলে শোনা যায়নি এবং অধিকাংশ ইউপি চেয়ারম্যান বা মেম্বরগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে পরপর কয়েক মেয়াদে নির্বাচিত হতেন। আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন মরহুম আব্দুস সামাদ শিকদার চাচা, সজ্জন এবং শুনেছি পৈত্রিক সম্পদ বিক্রি করে এলাকার মানুষের জনসেবা করেছেন। ওনার পূর্বে মোতালেব চাচাও নাকি একটানা দুই-তিন মেয়াদে ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন। দুজনকেই চোখের সামনে দেখেছি, তাঁদের সন্তানদের কেউ কেউ আমাদের সমবয়সী, বন্ধু, সহপাঠীও ছিলো। চেয়ারম্যানের সন্তান বলে তাদের মধ্যে বাড়তি কোন অহমিকা দেখিনি, এলাকার সাধারণ মানুষদের সাথে মিলেমিশেই চলতে দেখেছি তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকেও। এক কথায় তখনকার জনপ্রতিনিধিগণ সাধারণ মানুষের মাঝ থেকেই নিরপেক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতেন। এখনকার দিনের মতো প্রকট দলীয় চেহারা না থাকায় একসময় বলা হতো স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা দলনিরপেক্ষ এবং বেশীরভাগ জনপ্রতিনিধিগণ পকেটের টাকায় জনসেবা করতেন!
স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের চরিত্র বদলে দেয়া শুরু করে হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদের নয় বছরের স্বৈরাচারী সরকারের দুর্নীতিযুক্ত শাসনামল। মূলতঃ এরশাদ সাহেবের আমল থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানগিরি বা মেম্বরগিরি করে বিশেষ সুযোগ সুবিধার দিন শুরু হয়। বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন, বিদেশী দাতা সংস্থার অর্থ বা উপকরণ সহায়তা, রিলিফ বা অনুদান হিসেবে সৌদি আরব থেকে দুম্বার মাংস ইত্যাদি নগদ প্রাপ্তির প্রাচুর্যতায় ইউনিয়ন পরিষদ জনপ্রতিনিধিদের জন্য লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবির্ভূত হয়। মোতালেব চাচা বা সামাদ চাচাদের মতো সৎ মানুষদের পরিবর্তে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যায় কিছু সুবচন পটু অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে সিদ্ধহস্ত জনপ্রতিনিধি। তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে জনগণের মন জয় করে ভোটের পর বেমালুম সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে রিলিফের চাল, ডাল, গম নিজের ও অনুগত চামচাদের মধ্যে বিতরণ করতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে কোন দরিদ্র পরিবারের জন্য তিরিশ কেজি চাল বরাদ্দ থাকলে নিশ্চিত কুড়ি থেকে সর্বোচ্চ পঁচিশ কেজি বুঝে পায়। এই কারনে গ্রাম এলাকায় একটা কথা প্রচলিত আছে- ‘ভোটের পরে আর ফস করে না’।
এরশাদ চাচার পতনের পর সব রাজনৈতিক দল মিলে চমৎকার ইশতেহার দিয়ে জনগণের কাছে ভোট চাইলো। আওয়ামীলীগ ও এদেশের কথিত প্রগতিশীল ধারার মানুষেরা ধরেই নিয়েছিলো তাদের দল নিশ্চিত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চলেছে। কিন্তু ঐ যে ভাসমান ভোটার ও তৎকালীন আমার মতো তরুন ভোটারদের অধিকতর আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিলো বেগম খালেদা জিয়া। ভোটের ফলাফলে তারই প্রতিফলন ঘটিয়ে আওয়ামীলীগকে হতাশায় ডুবিয়ে ১৯৭৫ সালের পর থেকে রাস্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরেই থাকতে বাধ্য হতে হলো। দুই দলই এরশাদ পতনের আগে যেসকল অঙ্গীকার জনগণের সাথে করেছিলো তা বেমালুম ভুলে গিয়ে স্বৈরাচার চাচার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। কারণ আওয়ামীলীগ ১৯৯১ সালের পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে না পেরে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই তৎকালীন বিরোধী দলের নেতা শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়ে দিলো- “এই সরকারকে একদিনের জন্যও স্বস্থিতে থাকতে দেবো না”।
আক্ষরিক অর্থেই তাই হলো। খালেদা জিয়ার সরকারের একের পর এক ফাউল, সকল বিষয়ে অপরিপক্ক, দূর্বল ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমার মতো ভাসমান ভোটারদের কাছে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দিতে আরম্ভ করলো। ওদিকে উপনির্বাচনগুলোতে ভয়ানক রকম কারচুপি, ভোট ডাকাতি, বিরোধী দলের উপর মামলা হামলা ইত্যাদির কারণে আন্দোলনে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খ্যাত আওয়ামীলীগের হাতে বিভিন্ন ইস্যু জমা হতে আরম্ভ করলো। আসলে খালেদা জিয়ার সরকার সুশাসনের পরিবর্তে এরশাদ আমলের দুর্নীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার দিকেই ঝুঁকে পড়লো। নিজের দলীয় মন্ত্রী এমপিদের অবৈধ সুযোগ সুবিধা প্রদান, চাঁদাবাজি, ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ক্যাডার রাজনীতি, প্রশাসন ও পুলিশকে দলীয়ভাবে ব্যবহার করা সহ সব ধরণের নেতিবাচক রাজনীতি চর্চা অব্যাহত রইলো।
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের ফসল খালেদা জিয়ার বিজয়ী সরকার মূলত আমার মতো নির্দলীয় নিরপেক্ষ ভোটারদের আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করার কারণে। আওয়ামীলীগ সহ সকল বিরোধী দলের আন্দোলন ও অনাস্থার কারণে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংযুক্ত করতে বাধ্য হয় বিএনপি। খুবই হতাশ হয়ে যাই ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শাসনামল প্রত্যক্ষ করে, প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির ব্যাপক ফারাক থাকায় আমার মতো ভোটারদের বিকল্প চিন্তা করতে বাধ্য হতে হয়।
অবশ্য খাঁটি দলপ্রেমিক বা দলকানা মানুষের সুবিধা অনেক। তিনারা নিজের সমর্থিত দলের কোন ভুল জীবনেই চোখে দেখেন না। দলের কেউ চুরি করে ধরা পড়লেও বিরোধী দলকে দোষ দিয়ে, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব হাজির করে চোখ বুজে তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। নিজের সমর্থিত দলের মন্ত্রী এমপি নেতারা যাই করেন তাই শতভাগ সহমত। অর্থাৎ আমাদের দেশের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী সুবিধাবাদতন্ত্রে আক্রান্ত, নিজের দলের মানুষের জন্য তাদের কাছে অনৈতিকতা বলে কিছু নেই। এই সুবিধাবাদ জিন্দাবাদ মানুষের সংখ্যা অগনিত, এদের দলকানা বল্লেও ভুল হবে। এদের আপনি দেশের এক নম্বর শত্রু বলতে পারলেই ভালোভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন! বোধহয় খুব কঠিন করে বলে ফেললাম, আমার পাঠকদের অনেকেই অখুশি হবেন আমার মন্তব্যে। কেউ কেউ আমার লেখা ফিচার পড়াও বোধকরি বাদ দিয়ে দেবেন। কারণ আমিও অতি প্রতিক্রিয়াশীল লেখকদের লেখা সহ্য করতে পারি না। কিন্তু আমার শতভাগ বিশ্বাস এদেশের অধিকাংশ ভোটার হাসিনা খালেদার নির্লজ্জ দাস, এদের এই নিঃশর্ত দাসত্বের কবলে পড়ে বাংলাদেশ দূর্বৃত্তায়নের এক গভীর চক্রে আঁটকে গেছে।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply