কিশোর বয়স থেকে আমার আবাহনী ক্লাব, মোহনবাগান, আর্জেন্টিনা ফুটবল দল বা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি প্রতীকের প্রতি সমর্থন করার বিষয়টি যদি বর্ণনা করি তাহলে কোন একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারটি পরিষ্কার করা যেতে পারে। রেডিওতে ফুটবল লীগের বিভিন্ন খেলার ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে একসময় বিনা উছিলায় আসলাম, মোমেন মুন্নাদের খেলার প্রতি একটা পক্ষপাতিত্ব তৈরি হয়ে যায়। আসলে সেই বয়সে জানতামও না আবাহনী ক্লাব নাকি আওয়ামীলীগ দল কতৃক প্রতিষ্ঠিত, যখন দেখলাম আমার পরিবারে আমার বাবা সহ অধিকাংশ সদস্যরাই মোহামেডান ক্লাবের সমর্থক তখন কিন্তু আবাহনীর প্রতি আমার ভালোবাসা বা সমর্থন এক ফোটাও কমেনি। আমাদের সময়ের মানুষদের খেলাধুলার প্রতি প্রেম বলতে ফুটবলকেই ধরা হতো এবং আবাহনী মোহামেডানের খেলা মানেই অঘোষিত যুদ্ধ, দেশের খেলাপ্রেমীরা দুইভাগে বিভক্ত হয়ে খেলা উপভোগ করতো। হারজিত নিয়ে ট্রল, টিটকারি থেকে হালকা সংঘর্ষ পর্যন্ত ঘটতো সমর্থকদের মধ্যে।
একইভাবে আকাশবাণী কলকাতার খেলার ধারাবিবরণী শুনেই কলকাতার ফুটবল ক্লাব মোহনবাগানের সমর্থক হয়ে যাই কারো কোন প্রকার প্রভাব বিস্তার ছাড়াই। তবে অন্যান্য অনেকের মতোই ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার ফুটবল নৈপুণ্য আমাকে মুগ্ধ করেছিলো বিধায় আর্জেন্টিনা ফুটবল দলকে সমর্থন করতাম যদিও আমার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য ব্রাজিল ফুটবল দলের সমর্থক ছিলো। এছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যে প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষ থেকে বিস্কুট বা কাঠি লজেন্সের ব্যবস্থা করা হতো সেই প্রতীকের পক্ষে স্লোগান ধরতাম কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই অর্থাৎ সুবিধাবাদে বিশ্বাস! একসময় পাকিস্থান ক্রিকেট দলের সমর্থক ছিলাম ইমরান খানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব গুণের কারণে, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার জুটির দূর্দান্ত বোলিংয়ের প্রেমে মজে।
উপরের বিশ্লেষণটি সরলভাবে যদি দেখি তাহলে আমাদের জীবনে বিভিন্ন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল, ক্লাব, ঘটনা, প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক বিশ্বাস ইত্যাদি সমর্থনের বিষয়টিকে কিন্তু কোন ধরাবাঁধা নিয়ম বা ছকে আটকানো সম্ভব নয়। বহমান নদী যেমন বিভিন্ন দেশ বা এলাকাভেদে বিভিন্ন নাম ধারণ করে আপন গতিতে প্রবাহিত হতে থাকে আপনার জীবনে চলার পথেও নিজস্ব একটা মতামত আপনাআপনিই সৃষ্টি হয়ে যাবে। আপনার বাবা কোনো একটি দল সমর্থন করেন বলে আপনিও সেই দলের সমর্থক হবেন এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই। আপনি একজন স্বতন্ত্র ও ভিন্ন মানুষ বা স্বাধীনচেতা ব্যক্তি মননের অধিকারী, আপনি কাউকে কি কারণে সমর্থন করবেন তার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা একান্তই আপনার। সৃষ্টিকর্তা আপনাকে বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা যদি দিয়ে থাকেন সেই অনুষঙ্গগুলোর উপর ভিত্তি করেই আপনি নিজের সমর্থনের জায়গায় স্থির হয়ে পড়বেন, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে চাইলেও সেটা আপনার বিবেক ও বিবেচনার উপরই নির্ভরশীল। কারো দ্বারা প্ররোচিত না হয়ে নিজের পছন্দের একটি দল বা মতকে সমর্থনের বিষয়টি তাই ব্যক্তিগত সম্পত্তির মতো, সেখানে কারো হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
আমরা সাধারণত তাদেরই ব্যক্তিত্ববান হিসেবে বিবেচনা করি যিনি নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থাশীল, যিনি ঘনঘন মত পরিবর্তন করেন না বা কোন বিষয়ে নিজের পূর্বের মতামত পরিবর্তন করলেও সেটার সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে নিজে অবগত থাকেন। কারো দ্বারা প্ররোচিত হয়ে হুটহাট কোন সিদ্ধান্ত নেন না বা সামান্য সুবিধা বা অসুবিধার বিনিময়ে নিজেকে অন্যের কাছে বিকিয়ে দেন না। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের আপনি ভীষণ ব্যক্তিত্ববান হিসেবে মেনে নিতে পারেন, এক্কেবারে “হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না” অবস্থা যাকে বলে। আমার পরিচিত বহু রাজনৈতিক সমর্থকদের কাছ থেকে দেখেছি কি অগাধ বিশ্বাস নিয়ে নিজ নিজ দলের প্রতি অনড় সমর্থন নিয়ে থাকে। তাদের এই ভালোবাসা এতোটাই গভীর যে, বিনা স্বার্থে নিজ দলের এজন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জীবন দিতেও কুন্ঠাবোধ করেন না!
ধরুন আপনার দল বিরোধী দলে আছে। সরকারী দলের হাজারো অত্যাচার, নির্যাতন, হামলা, মামলা, নিগ্রহ, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার হলেও নিজের সমর্থিত দলের প্রতি অগাধ আস্থা আপনার ইহকালে ছুটে যাবে না। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের এরকম একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি গোড়া সমর্থনের বিস্ময়কর একটা স্নায়ু রক্ষিত আছে। আবার ধরেন আপনার দল ক্ষমতায় আছে। এখন নিজের সমর্থন করা দলের কেউ প্রকাশ্যে খুন করলে, চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হলে, ঘুষ খেয়ে হাতেনাতে ধরা পড়লে, অন্যের জমি বা সম্পত্তি দখল করলে, অবৈধ অস্ত্র সহ আটক হলে কিম্বা মাদক কারবারী হলেও তার বা তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার এক নিকৃষ্ট রাজনৈতিক সংষ্কৃতিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবো সেই সুক্ষ বোধ আমার মধ্যে কিছুতেই কাজ করে না।
তবে সমর্থক হিসেবে আমি ফ্লেক্সিবল বা উদার বলতে পারেন। আবার এমনটাও না যে স্বার্থের কারণে বা অন্যের প্ররোচনায় আমার সমর্থন বদলে ফেলবো। আমাকে বলতে পারেন নিজের বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ একজন ব্যক্তি, আমি একসময় পাকিস্থান ক্রিকেট দলকে সমর্থন করতাম কিন্তু এখন করি না। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বাইরে এখন নিউজিল্যান্ড বা সাউথ আফ্রিকা দলের সমর্থন করি। টেন্ডুলকার, দ্রাবিড়, সৌরভ গাঙ্গুলী, ধোনীদের আমলে কিছুদিন ভারতীয় ক্রিকেট দলকেও পছন্দ করতাম। এমন দলবদলে পটু আমাকে নেতিবাচক অর্থে আপনি অকার্যকর ভাসমান সমর্থক অথবা ইতিবাচক অর্থে মুক্তমনা সমর্থক বলতে পারেন। আমি আমার নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগার দাসত্ব করি, আমি আওয়ামীলীগেরও যেমন ভুল ধরতে পারি তেমন বিএনপিকে ভোট দিলেও সমালোচনা করতে পিছুপা হই না।
আমার মতো এমনতর সমর্থকদের কারনেই আমাদের দেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুই রাজনৈতিক দলের জনগণের ভোটের উপর আস্থা নেই। এমন বিচ্ছু ঘরানার মতাদর্শের ভোটারদের কারণে এদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কোন রাজনৈতিক দলের পরপর দুইবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আর সেই কারণেই একবার কেউ ক্ষমতার মসনদে আরহণ করলে সহজে তা ছাড়তে ভরসা পায় না! ভাসমান ভোটাররা বড়ই বিপদজনক ব্যাপার ক্ষমতাসীনদের জন্য, কারণ এদেশের রাজনৈতিক ধারা হলো জবরদস্তিমূলক। মিথ্যা, ভন্ডামি, চাটুকারিতা, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, লুটপাটই হলো আওয়ামীলীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের রাষ্ট্র শাসন করার মূলনীতি। অনেকটা এমন “তোদের দলের চোরদের চেয়ে আমাদের দলের চোরেরা কম চোর”।
(চলবে)
লেখা: পল্লব খন্দকার
সত্ত্ব: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply