২৫ জুন দক্ষিন বঙ্গের অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে চির অবহেলিত মানুষের আজীবন লালিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের প্রথম বার্ষিকী! পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের আবেগকে বাড়াবাড়ি ধরনের মনে করতে দেখেছি চট্টগ্রাম, সিলেট বা ময়মনসিংহ বিভাগের অনেক মানুষকে। পূর্ব বঙ্গের মানুষদের কাছে বরং পদ্মার ফেরিঘাট, ঝালমুড়ি, ঢেউয়ের কলতান বেশি সুখদায়ক স্মৃতি হিসেবে বেঁচে আছে। আমাদের বঙ্গের অনেকেও সেইসব দিন নিয়ে কিছুটা স্মৃতিতাড়িত হয়ে আবেগান্নিত হয়ে পড়েন তবে যখন পাঁচ মিনিটে পদ্মা পার হয়ে যান ঠিকই মনে পড়ে ১৪-১৫ ঘন্টা ফেরির জ্যামের অসংখ্য স্মৃতি! দুঃসহ সেসব স্মৃতি এক বছরের মাথায় আজ সুদুর অতীত মনে হয়, আমরা দ্বিতীয় পদ্মা সেতুও হয়তো পেয়ে যাবো কোনদিন। সেদিন আর কেউই মনে করতে চাইবে না আরিচা, দৌলদিয়া, পাটুরিয়া ফেরিঘাটে অসহায়ের মতো শত শত ঘন্টার অপেক্ষায় মানসিক আর শারীরিক অবসাদের দিনগুলো।
২৫ জুন ২০২২ সালে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ঘোষণা আসার সাথে সাথেই এক অনাবিল ভালোলাগায় নেচে উঠেছিলো কোটি মানুষের প্রাণ। দলমত নির্বিশেষে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ঐতিহাসিক ২৫ জুনের, অনেকে কৌতুহলী বা সন্দিহানও ছিলেন বৈকি? সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত উদ্বোধনের লাল ফিতা কেটে অদম্য বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে খুলে দিলেন দক্ষিন বঙ্গের উন্নয়নের স্বর্ণ দুয়ার। আমরা দক্ষিনবঙ্গবাসী তখন কৃতজ্ঞতায় চোখের কোনায় কিছুটা আদ্রতায় বরণ করে নিয়েছিলাম স্বপ্ন ও উন্নয়নের সেতুবন্ধন পদ্মা সেতুকে। যদিও এখনো যাত্রাবাড়ি থেকে যাতায়াতের হিসেবটাই মূখ্য, কারন খুলনা বা বরিশাল যেতে বা আসতে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা লাগে ঐ যাত্রাবাড়ির প্রান্তকে বিবেচনা করে। অনেকেই অভিযোগ করেন পদ্মা সেতু হয়ে লাভ তো কিছুই হয়নি, যাত্রাবাড়ি থেকে উত্তরা বা মিরপুর যাতায়াতে তো সেই আড়াই তিন ঘন্টাই লাগছে?
ওসব হিসেব চলতে থাকুক, আমরা দক্ষিনের উন্নয়ন বঞ্চিত মানুষদের জন্য এই পদ্মা সেতু যে কতোটা আশীর্বাদ তা এক বছরেই প্রমাণিত।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সিনিয়র সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু জানান, ‘পদ্মা সেতুর কারণে গতিশীল হয়েছে মোংলা বন্দর, পায়রা ও বেনাপোল বন্দরকেন্দ্রিক কার্যক্রম। মোংলা বন্দর থেকে মাত্র তিন ঘণ্টায় ঢাকায় পণ্য আসতে পারছে। আগে লাগত ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা। মোংলা থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে আগে লাগত ১৪ ঘণ্টা। সেতুর কারণে তা কমে হয়েছে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। সব মিলিয়ে ১২ ঘণ্টা সময় এগিয়ে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এই বেঁচে যাওয়া সময়টাই হলো অর্থনীতির বড় পুঁজি।’
বন্দরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এই সময়ে মোংলায় কনটেইনার হ্যান্ডেলিং, বিদেশি জাহাজ আগমন ও নির্গমন, বেনাপোলে মালপত্র লোড-আনলোড ও রাজস্ব আয় আগের তুলনায় দ্বিগুণ হয়েছে।
পরিবহন মালিক সমিতির তথ্য বলছে, পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন অঞ্চলের যাতায়াতে পরিবহন মালিকদের নতুন বিনিয়োগ হয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এক শরীয়তপুর জেলাতেই নতুন বাস নেমেছে দুই শতাধিক।
সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, পদ্মা সেতু চালুর পর খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ টন তাজা মাছ পরিবহন হচ্ছে। আর কৃষিপণ্য যাচ্ছে দৈনিক ৬০০ টন।
অনেকে ভেবেছিলেন পদ্মা সেতুর সুবিধাটা শুধু খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, মাগুরা বা নড়াইলের জনগন পাবে। ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ায় হয়তো তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না; কিন্তু সেতু চালুর পর দেখা যাচ্ছে, উল্লেখিত জেলার জনগনও পদ্মা সেতুর সর্বোচ্চ সুফল পাচ্ছে। মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকায় পৌঁছে যেতে পারছে। একই সময়ের মধ্যে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সবজি, ফল, ফুল ও মাছও পৌঁছে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানের খোঁজ কিংবা শিক্ষা-চিকিৎসার উদ্দেশ্য যেটাই হোক—এখন দিনের মধ্যেই ঢাকা থেকে কাজ সেরে বাড়ি ফেরা সম্ভব হচ্ছে। তা ছাড়া পদ্মা সেতু চালুর কারণে স্থানীয় পণ্যের ভালো দাম মিলছে। মানুষ বেশি উৎপাদন করছে। এতে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্যেও নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।
পল্লব খন্দকার, ২৬ জুন ২০২৩।
কৃতজ্ঞতাঃ দৈনিক কালবেলা অনলাইন পত্রিকার কিছু তথ্য সংকলিত।