স্মার্ট বাংলাদেশ ও প্রযুক্তি: অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরী (পর্ব-১)
স্মার্ট বাংলাদেশ ও পরিবেশ:
প্রথমেই যদি পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দেয়া যায় তাহলে দেখতে পাই প্রতিনিয়তই বাড়ছে বাতাসে কার্বনের পরিমাণ। কলকারখানা সহ শিল্পায়নের দ্রুত প্রসারণের জন্য বাতাসের সাথে দূষিত হচ্ছে মাটি এবং পানি। যার ফলে পৃথিবীর দুই মেরুর বরফ আশঙ্কাহারে গলতে শুরু করেছে। যার প্রত্যক্ষ ক্ষতিতে পড়ছে আামাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। এছাড়া এক গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জলবায়ুর বিরাট পরিবর্তন সাধিত হবে। গরমকালে তাপমাত্রা বাড়বে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস আর শীতকালে কমবে ১.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গরমকালে বৃষ্টিপাত বাড়বে শতকরা ১১ ভাগ কিন্তু শীতকালে কমবে শতকরা ৩ ভাগ। গরমকালে বাষ্পীভবন বাড়বে ১৮.৮ ভাগ এবং শীতকালে বাড়বে ০.৯ ভাগ। এছাড়া ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত, এর ফলে বিশ্বের তিন হাজার মিলিয়ন হেক্টর জমি স্থায়ীভাবে হারিয়ে যাবে আর বাংলাদেশের এক– পঞ্চমাংশ চলে যাবে সমুদ্রের অতলে! অবাক করা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে ১৭ টি নদী। বিশ্ব জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকি –২০০৬ এর মূল্যায়নে যে ১০টি দেশকে ঝুকিপূর্ণ দেশ বলে চিহ্নিত করে সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দুই নম্বরে। তাই দেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর জ্ঞান, যা দ্বারা আমরা আমাদেরকে রক্ষা করতে পারি। স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে জলবায়ুর পূর্বাভাস, প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে অগ্রীম জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিকর প্রভাব নিরূপণ ও টেকসই সম্পদ ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব।
স্মার্ট বাংলাদেশ ও বেকারত্ব:
অধিক জনসংখ্যার বিশাল চাপের মধ্যে বেকারত্ব বাংলাদেশের অন্যতম এক প্রলয়ঙ্কারী সমস্যা। মিলিয়ন মানুষ বেকারত্বের অভিশাপে আজ জর্জরিত। যুবক শ্রেণী এর প্রত্যক্ষ শিকার। হতাশার বিষয় হচ্ছে দিনকে দিন বেকারত্বের হার বেড়েই চলেছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারের হার বাংলাদেশে ১০.৭ শতাংশ যা এই অঞ্চলের ২৮ টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। যার পিছনে কাজ করছে বেশ কিছু নিয়ামক। এর মধ্যে অন্যতম হলে যথাযথ কাজের সুযোগের অভাব এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতার অপ্রতুলতা। যার ফলে প্রতিষ্ঠান কর্মী খুঁজে পাচ্ছে না আবার কর্মীও প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পাচ্ছে না। যার ফলে আমাদের কর্মক্ষেত্রে ভাগ বসাচ্ছে অন্যদেশের জনগণ। কারণ মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি সবসময় চায় যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিই উপযুক্ত চেয়ারে বসুক। শুধু বেসরকারি পর্যায় না সরকারি পর্যায়েও মাঝে মাঝে দেখা যায় উপযুক্ত ব্যক্তির অভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল বলে গণ্য হচ্ছে। এতে করে প্রতি বছরই হাজারো স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করে বেকারত্বের খাতায় নাম লিখে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যা দেশকে অর্থনৈতিক ভাবেও পেছনে ফেলে দিচ্ছে। আর এই কর্পোরেট মার্কেটে টিকে থাকার জন্য দক্ষতা সৃষ্টি না হওয়ার পিছনে শিক্ষার অব্যবস্থাপনা বিরাট এক নিয়ামক। বর্তমানে দেশে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্বেও দেখা যায় শুধুমাত্র সচেতনার অভাবে অধিকতর মেধাবী শিক্ষার্থীরা এসকল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চায় না। কারিগরি শিক্ষায় অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজন যথাযথ উদ্যেক্তা তৈরি এবং স্মার্ট কারিগরি শিক্ষার প্রসার। এই বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যুক্ত করা হয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশের মূলনীতিতে।
স্মার্ট বাংলাদেশ ও নারী–পুরুষে বৈষম্য:
আজ দেশে নারী পুরুষের বৈষম্য শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভবপর হলেও গ্রামাঞ্চলে এর প্রকোপ এখনো অনেক বেশি। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, যৌতুক বা পণপ্রথা সহ নানান ধরনের সমস্যা। স্মার্ট সিটিজেনের আওতায় যখন দেশের সকল স্তরের সকল মানুষ একই সুবিধার অধিকারী হবে তখন শহরের নারীদের মতো করেই সচেতন এবং শিক্ষিত হবে গ্রামের পিছিয়ে পড়া নারীরা। তখন তারা নিজের অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে।
স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গৃহীত পদক্ষেপ:
১. বাংলাদেশ হাই– টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের আওতায় সেলফ – এমপ্লয়মেন্ট ও এন্ট্রেপ্রেনরশিপ ডেভেলপমেন্ট প্লাটফর্ম ও বাংলাদেশ নলেজ ডেভেলপমেন্ট পার্ক স্থাপন করা হবে।
২. বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের আওতায় সেন্টার ফর লানিং ইনোভেশন অ্যান্ড ক্রিয়েশন অব নলেজ এবং অল্টারনেটিভ স্কুল ফর স্টার্টআপ এডুকেশন ফর টুমোরে স্থাপনের উদ্যেগ গ্রহণ করা হবে
৩. ওয়ান স্টুডেন্ট – ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম আওতায় শিক্ষার্থীদের ল্যাপটপ প্রদান কার্যক্রম আরও ত্বরান্বিত হবে
৪.ডিজিটাল লিডারশিপ অ্যাকাডেমি স্থাপন করা হবে।
৫. ক্ষুদ্র ছোট এবং মাঝারি ব্যবসাগুলোর জন্য এন্টারপ্রাইজ ভিত্তিক বিনিয়োগ উপযোগী স্টার্টআপ হিসাবে তৈরি করা হবে।
স্মার্ট বাংলাদেশের অর্জন কি হবে?
উপরোক্ত পদক্ষেপ সমূহের মাধ্যমে তৈরি হবে স্বাধীনচেতা একেকজন উদ্যেক্তা। যারা তাত্ত্বিক এবং প্রয়োগিক দুই শিক্ষাতেই হবে অনবদ্য। তাত্ত্বিক শিক্ষাকে যথাযথ প্রয়োগ করতে তাদের সামনে থাকবে যথেষ্ট আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সরঞ্জাম। তারা জানবে আইটি বিষয়ক তথ্য, তারা জানবে কমিউনিকেশন বিষয়ক তথ্য। তারা জানবে নেটওয়ার্কিং বিষয়ক তথ্য। যার মাধ্যমে পৃথিবীর বড় বড় বিনিয়োগকারীদের সাথে কথা হবে সরাসরি। যারা কখনো চাকরির পিছনে ঘুরবে না। নিজেরা হবে এক একটি কোম্পানির প্রধান। যেখান থেকে তৈরি হবে লাখো কর্মসংস্থান। যেখানে দরদাম হবে বিদেশি ক্রেতাদের সাথে। আসবে রেমিটেন্স নামক সোনার হরিণ। এইসব পদক্ষেপের আওতায় থাকবে নেতৃত্ব দানের গুণাবলী অর্জনের শিক্ষা প্রদান। যার মাধ্যমে তৈরি হবে সামাজিক ভারসাম্য। সমাজ পাবে যোগ্যতম পথ প্রর্দশক, যে সবার সামনে উচ্চারণ করবে দৃঢ় বক্তব্য, যার কাজে প্রকাশ পাবে অবিচল পদক্ষেপ। যত বন্ধুর পথই হোক না কেন সে এগিয়ে যাবে দূর্বার গতিতে। ইউরোপের যুবসমাজের টক্কর হবে বাংলাদেশের যুবসমাজের। তাদের শিশুদের সাথে টক্কর হবে আমাদের শিশুদের।
বর্তমানে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাগণ প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাবে বাজারে পিছনের দিকে অবস্থান করছে। উপরোক্ত পদক্ষেপের মাধ্যমে এই ব্যবসাগুলোতেও আসবে দেশি বিদেশি বিনিয়োগ ব্যবস্থা। যার ফলে পালে হাওয়া পাবে এই এই ধরনের উদ্যোক্তাগণ। এখানেই তৈরি হবে স্বল্প শিক্ষিত বা সাধারণ জনগণের জন্য কর্মসংস্থান। এছাড়া ভর্তুকি বা সেবা খাতের অর্তভূক্তির মধ্যেও থাকবে নানা সুবিধা যার মাধ্যমে তৈরি হবে সুযোগ এবং সম্ভাবনা।
স্মার্ট বাংলাদেশ ও শেষ কথা:
আমাদের দৃড় আশা মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ ক্ষুধা ও দারিদ্র মুক্তির লক্ষ্যে স্মার্ট পদক্ষেপে দেশ এগিয়ে যাবে স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে। প্রযুক্তি এবং দক্ষতার সমন্বয়ে তৈরি হবে নতুন প্লাটফর্ম। যে প্লাটফর্মে থাকবে শুধু বিজয়ের সুবাতাস। থাকবে না দুঃখ বা দারিদ্র্যতার বিন্দুমাত্র ক্লেশ। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে দেখতে থাকবে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের কর্মস্পৃহা। তারজন্য এখন প্রয়োজন শুধুমাত্র পরিকল্পনা মাফিক কাজে অংশগ্রহণ এবং দেশের যুব সম্প্রদায় এবং শিক্ষিতদের সামনে এগিয়ে আসা। স্মার্ট বাংলাদেশের আড়ালে পৃথিবী পাবে এক ঝাঁক দক্ষ অদম্য প্রয়োগিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ নেতৃত্বদানে অটল জনশক্তি। যার মাধ্যমে সোনার দেশটা সত্যিকারের সোনায় ভরে উঠবে। পূরণ হবে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা। সেইদিনের অপেক্ষায় আজ থেকেই আশায় বুক বাঁধলাম স্মার্ট বাংলাদেশ দেখার প্রত্যয়ে ৷ জয়তু স্মার্ট বাংলাদেশ।
(দুই পর্বে সমাপ্ত)
মোঃ আফসারুল আলম মামুন
৪র্থ বর্ষ, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইলঃ ০১৯৩৪৬২৪৪২৮
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply