একটি দেশকে গড়ার জন্য সবার প্রথমে প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধন। তারই সাথে প্রয়োজন দক্ষ জনশক্তি। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তির দ্বারাই একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে সচল করা সম্ভব। দক্ষ জনশক্তি তাকেই বলা হয় যখন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝে হাতে কলমে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট কাজের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হয়। আর এরই মাধ্যমে যখন দক্ষ জনশক্তি, জনসম্পদে পরিণত হয় এবং তার সাথে প্রযুক্তি ক্রমবর্ধমান উৎকর্ষ সাধিত হয় তখনই কেবল একটি দেশ উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহন করতে পারে।
বর্তমান সরকার ঘোষিত স্মার্ট বাংলাদেশের চারটি মূল স্তম্ভ হলো:
১. স্মার্ট সিটিজেন বা স্মার্ট জনগণ
২. স্মার্ট সোসাইটি বা স্মার্ট সমাজ
৩. স্মার্ট ইকোনমি বা স্মার্ট অর্থনীতি
৪. স্মার্ট গভার্নমেন্ট বা স্মার্ট সরকার
স্মার্ট সিটিজেন বা স্মার্ট জনগণ বলতে বুঝায় যে বাংলাদেশে থাকবে না গ্রাম - শহরের প্রার্থক্য, গ্রাম এবং শহরের মানুষ একই সুযোগ-সুবিধার অধিকারী হবে। শহরের মানুষ ঘরে বসে যেসব কাজ অনায়েসে করতে পারে গ্রামের মানুষও সেই কাজ সাবলীলভাবে সম্পন্ন করতে পারবে। হোক সেটা পাসপোর্ট তৈরি বা ভিসা প্রসেসিং। গ্রামের স্কুল গুলোতেও যোগ হবে দেশবরেণ্য শিক্ষকদের পাঠদান। গ্রামেই তৈরি হবে উন্নতমানের হিমাগার, গ্রামেই আসবে শহরের বড় বড় আড়তদার। সম্পন্ন হবে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, সম্ভব হবে উচ্চ-মধ্য- নিম্ন বিত্তের মধ্যে আয়ের বৈষম্য হ্রাসকরণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি (প্রায় ১২ হাজার ৫০০ ডলারে উন্নতিকরন)। কৃষক-মজুরদেরও থাকবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, যা দ্বারা লেনদেন হবে শহরের ক্রেতাদের সাথে, মধ্যস্বত্ব ভোগীদের দৌরাত্ম নেমে আসবে শূন্যের কোটায়। থাকবে পঞ্চম প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা৷ যার ফলে একদিকে সৃষ্টি হবে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা সেই সাথে খুলে যাবে ফ্রিল্যান্সিং এর নতুন দুয়ার।
স্মার্ট সোসাইটি বা স্মার্ট সমাজ বলতে বুঝায় সেই সমাজ ব্যবস্থা সেখানে থাকবে না স্বচ্ছতা বা জবাবদিহিতার ন্যূনতম পদস্খলন। সমাজের প্রতিটি মানুষ একই বাটখারায় ওজনের যোগ্য হবে। রাষ্ট্রের সকল মানুষ আইনের সকল সুযোগ সুবিধা সমানভাবে ভোগ করবে। সমাজ ব্যবস্থায় উঁচু থেকে নিচু, আইন প্রণেতা থেকে সাধারণ দিন মজুর, সংখ্যাগুরু থেকে সংখ্যালঘু, বাঙালি থেকে উপজাতি কোন বৈষম্য সৃষ্টি হবে না। সবাই নিজ নিজ জায়গায় সম্মানের অধিকারী হবে।
স্মার্ট ইকোনমি বা স্মার্ট অর্থনীতি হলো সেটা, যেখানে থাকবে নগদ টাকাবিহীন লেনদেন। লেনদেনের জন্য কাগজের টাকার প্রচলন কমে গিয়ে মোবাইল মানির প্রচলন ঘটবে সূদুরপ্রসারীভাবে। এছাড়া জনগণের অর্থনৈতিক সকল তথ্য থাকবে সরকারে কাছে যার ফলে দেশের সাথে বন্ধ হবে সকল প্রতারণা। কালোটাকা আয়কারীদের সকল কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে। আয়কর রিটার্ন, ভ্যাট, শুল্ক (আবগারী বা সম্পূরক) সকল কিছুই মিমাংসা হবে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে। স্মার্ট অর্থনীতির মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে একটি উন্নত দেশ, যেখানে বর্তমান মূল্যে মাথাপিছু আয় হবে ১২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার। এছাড়া বিশ্বের দিকে নজর দিলে দেখা যায় আগের তিনটি শিল্প বিপ্লবের চেয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে বিশ্বে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) তথ্যমতে জ্বালানি, পরিবহন, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং ডিজিটাল উৎপাদন- এই পাঁচটি প্রধান ক্ষেত্র দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হবে।
স্মার্ট গভার্নমেন্ট বা স্মার্ট সরকার বলতে বুঝায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর হয়ে জনগণের সাথে থাকবে জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি যোগাযোগ। সকল উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের বাজেটে থাকবে জনগণের পরোক্ষ নজর। যার ফলে উন্নয়ন কার্যক্রম বিলম্ব করে বাজেট বাড়ানোর অপপ্রয়াস বন্ধ হবে সহজেই। টেনে ধরা যাবে দূর্নীতির লাগাম।
আর এইভাবেই 'স্মার্ট বাংলাদেশ ' রূপকল্পে কৃষি, শিক্ষা, বাণিজ্য, পরিবহন, পরিবেশ, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো, বাণিজ্য, গভর্ন্যান্স, আর্থিক লেনদেন, সাপ্লাই চেইন, নিরাপত্তা, এন্টারপ্রেনিউরশিপ, কমিউনিটির মতো খাত প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে এবং প্রতিটি খাত হবে স্মার্ট। যেমন স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট শিক্ষা ইত্যাদি।
স্মার্ট কৃষি:
আমরা যদি স্মার্ট কৃষির দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাই সেখানে তৈরি হচ্ছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে উৎপাদনমুখী, লাভজনক ও টেকসই ফসল খাত গড়ে তোলার ভিশন নিয়ে কাজ করে কৃষি মন্ত্রণালয়। যার মিশন হচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও লাভজনক কৃষি খাত গড়ে তোলার লক্ষ্যে যথাযথ প্রযুক্তি উদ্ভাবন, হস্তান্তর এবং উপকরণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল খাতের উৎপাদন বৃদ্ধি করে একটি দক্ষ ও পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
যার জন্য তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ইনস্টিটিউট। যারা প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কৃষিকে আধুনিক করার লক্ষ্যে তৈরি হচ্ছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্ত হচ্ছে আইসিটি কার্যক্রম। তার মধ্যে অন্যতম:
১. | কৃষি তথ্য যোগাযোগ কেন্দ্র ( AICC) |
২. | কৃষি আলাপনি (SMS / MMS) |
৩. | কমিউনিটি রেডিও |
৪. | প্রমোশনাল টিভি |
৫. | সমৃদ্ধ ওয়েবসাইট ইত্যাদি |
আর এইভাবেই স্মার্ট কৃষিই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম হাতিয়ার।
স্মার্ট শিক্ষা:
এছাড়া স্মার্ট শিক্ষার আওতায় তৈরি হচ্ছে আধুনিক শিক্ষা কার্যক্রম। পরিবর্তন আসছে শিক্ষা সিলেবাসে। তৈরি হচ্ছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল দ্বারা গঠিত শিক্ষা কার্যক্রম। যেখানে অন্তভূর্ক্ত হচ্ছে প্রয়োগিক শিক্ষা। স্মার্ট করার নিমিত্তে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, কলা ও গণিতের শিক্ষাটাই প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে তুলে ধরা হবে। সেটা রোবট, এআই বা প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে হতে পারে। বর্তমানে বিশ্ব আজ যেটা করে দেখাচ্ছে। সাধারনত ৩০ জন শিক্ষার্থীকে যদি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে একটি ক্লাসরুমে শিক্ষা প্রদান করা হয়, তাহলে তার শিক্ষার মান হয় এক রকম; তাকে যদি মাস্টারিং পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান কারা হয় তাহলে সে একটু বেশি শেখে; তারপর ওয়ান টু ওয়ান পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদান করা হলে সেখানে ফলাফল আরও ভালো হয়। আমাদের ক্লাসরুমগুলোকেও স্মার্ট হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে । যার জন্য কাজ করে যাবে শিক্ষা বিষয়ক কমিশন সমূহ। স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি হবে সম্পূর্ণ ক্লাউড নির্ভর। আর তারজন্যই ঢেলে সাজানো হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা।
স্মার্ট বাংলাদেশ আজ সময়ের দাবী, কারণ প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে টিকে থাকলে হলে থাকতে হবে প্রযুক্তিগত জ্ঞান, উন্নত গবেষণা আর দক্ষ ও জবাবদিহিতা মূলক নেতৃত্ব। কেননা সামনের সময় খুবই চ্যালেঞ্জিং। যেগুলোর ভিতরে রয়েছে পরিবেশ, আন্তর্জাতিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় সহ নানান অধ্যায়।
(চলবে------------------------)
মোঃ আফসারুল আলম মামুন
৪র্থ বর্ষ, পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইলঃ ০১৯৩৪৬২৪৪২৮
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।