Sapiosexual বা স্যাপিওসেক্সূয়াল শব্দটি একটি স্প্যানিশ শব্দ। এটির অর্থ হলো, বুদ্ধিমত্তার প্রতি যৌনরূপ আকর্ষণ বা উদ্দীপনা। যে ব্যাক্তির মধ্যে এটি থাকে তাকে বলা হয় স্যাপিওসেক্সূয়াল। এই স্যাপিওসেক্সূয়ালিটি হলো একজন ব্যাক্তির অপর একজন তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যাক্তির প্রতি তীব্র আকর্ষণ বা উদ্দীপনা বোধ।
বর্তমান যুগে অনেকে তাঁর সঙ্গী বাছাইয়ের জন্য এটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করে থাকেন। এটি একটি তুলনামূলকভাবে নতুন শব্দ যা, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, মানুষ প্রাকৃতিক বা জন্মগত ভাবেই বুদ্ধিমত্তার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে থাকে। যার মধ্যে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে, স্বভাবতই তাকে প্রায় সবাই সমীহ করে থাকেন। আমরা প্রায়ই এমন ব্যাক্তিদের পছন্দ করি এবং একসাথে চলি। আমরা নিজেরাও নিজের অজান্তেই এমন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন হতে পারি।
স্যাপিওসেক্সূয়াল এর বৈশিষ্ট্য কি কি?
১) যে কোনভাবে একটা পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়। একজন আরেকজন কে বুঝতে চেষ্টা করে থাকেন। ধীরে ধীরে এটি গভীরতর হয়। আর এটায় যে উপাদানটি কাজ করে তাহলো বুদ্ধিমত্তা।
২) এমন ব্যাক্তি প্রায় ছোট ছোট বা অপ্রয়োজনীয় কথাবার্তা এড়িয়ে চলেন। বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বা রসবোধপূর্ণ কথা বলা ব্যাক্তির প্রতি আকর্ষণ, উদ্দীপনা বা ভালো লাগা কাজ করে থাকে। তার সাথে অতিরিক্ত সময় কাটাতে ভালো বোধ হয়।
৩) এরূপ ব্যাক্তি প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ভালবাসেন।
৪) এরূপ ব্যাক্তি বিনয়ী হয়ে থাকেন। যারা পরদুঃখকাতর, সহানুভূতিশীল এবং একে অন্যকে বুঝে থাকেন, তারা এরূপ ব্যাক্তিকে পছন্দ করেন এবং বুদ্ধিমত্তার একটি বৈশিষ্ট্য বহন করে এর মাধ্যমে।
৫) এরূপ ব্যাক্তি দারুণ যোগাযোগ সম্পন্নকারী। হাসি যেন এদের মুখে লেগেই থাকে।
৬) এরূপ ব্যাক্তি একে অপরের প্রশংসা করে থাকেন। এবং যদি আপনাকে আপনার শারীরিক বৈশিষ্ট্য এর চেয়েও বেশি কিছু বলে থাকে তাহলে এটি নিশ্চিত যে আপনার বুদ্ধির জন্যই এমনটা ঘটেছে।
৭) এরূপ ব্যাক্তি দুর্দান্ত বন্ধু বানিয়ে থাকেন। তারা ক্রমবিকাশের বা উন্নতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হন এবং অন্যকে অনেক কিছু শিখিয়ে থাকেন।
আপনি কি স্যাপিওসেক্সূয়াল?
ইদানীংকালে ফেসবুক, লিংডইন, বিভিন্ন ব্লগে ‘স্যাপিওসেক্সূয়ালিটি’ নিয়ে খুব কথাবার্তা চলছে। অনেকেই নিজেদের ‘স্যাপিওসেক্সূয়াল’ হিসেবে চিহ্নিত করছে ফেসবুকে বা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ব্যাপারটা এমন যে, বিষয়টি সম্পর্কে তারা কেবলই জানল এবং সেই স্বল্প জানা অনুযায়ী তারা এক্কেবারে নিশ্চিত যে তারা অবশ্যই সেপিও। এটা খুবই হাস্যকর। বিষয়টি সম্পর্কে দু-চার লাইন শুনেই, গভীরভাবে না বুঝেই কিন্তু তারা নিজেদের স্যাপিওসেক্সূয়াল হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে না। কারন নর-নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে হুট করেই একটা বেঞ্চমার্ক বা সীমারেখা টানার সুযোগ নেই। সেপিও হওয়া মানে নিজেকে বেশ আলাদা রকম মর্যাদাবান হিসেবে ভেবে নিজে নিজেই জাতে ওঠার চেষ্টা করার আগে অবশ্যই নিজের ব্যাক্তি আচার আচরণ, অন্যের সাথে পারষ্পারিক ব্যবহার ইত্যাদি ভালোভাবে জানতে হবে।
নিজেকে স্যাপিওসেক্সূয়াল হিসেবে ভাববার পূর্বে কিছু বিষয়ে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে। আমরা জানি সাধারণত মানুষ যখন কারো প্রেমে পড়ে প্রথমতঃ সে চেহারা এবং বাইরের সৌন্দর্য্যের প্রেমে পড়ে। কিন্তু স্যাপিওসেক্সূয়ালেরা চেহারা বা শারীরিক সৌন্দর্য দেখে নয়, একজনের ব্যক্তিত্ব বা বুদ্ধিমত্তার প্রেমে পড়ে। স্যাপিওসেক্সূয়ালদের প্রেম ও যৌনতার অনুভূতি মস্তিষ্কে চাপা পড়ে যায়। শারীরিক সৌন্দর্য্য বা সামাজিক অবস্থার চেয়ে কাছের মানুষের বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কাছের মানুষের পারিবারিক, সামাজিক বা ব্যাক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করার গভীরতা, চিন্তার ভিন্নতা, কৌতূহল, মানসিকতা তাদের আকর্ষণ করে। মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, দার্শনিক আলোচনা থেকে তার চাহিদা পূরণ করে, এবং মনে করে কারো যৌন আকর্ষণ শরীরে নয়, বরং তার প্রতিভার বিপরীতে লুকিয়ে থাকে। ভাবতে হবে আপনিও কি এমন?
স্যাপিওসেক্সূয়াল মানুষ হঠাৎ করে কারো প্রেমে পড়ে না। শারীরিক সৌন্দর্য্যের প্রতি আকৃষ্ট না হওয়ায় প্রেমে পড়তেও সময় লাগে। ফলে অধিকাংশই প্রেমের আগে বন্ধু হয়ে যায়। সময়ের সাথে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক থাকলে তাদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায়। তবে মেধা বা বুদ্ধির আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি হলেও শারীরিক আকর্ষণ যে একেবারে নেই তা নয়। কিন্তু তাদের জন্য শারীরিক আকর্ষণ খুবই সাময়িক। দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্কের জন্য চেহারা কখনোই তাদের কাছে খুব বড় হয় না । স্যাপিওসেক্সূয়াল কাউকে পছন্দ করা মানে সহজে তাদের পছন্দের পরিবর্তন হয় না। কারণ তারা কাউকে পছন্দ করতে সময় বেশ নেয়। ভালোবাসা তখনই হয় যখন অপর পক্ষের মানুষটির সাথে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পর্ক থাকে । ফলে কাউকে ভালো লাগলে তাকে খুব সিরিয়াস মনে হয়।
যারা চিৎকার করে, রাগ করে তারা স্যাপিওসেক্সূয়াল মানসিকতার মানুষের দ্বারা ঘৃণিত হয়। স্যাপিওসেক্সূয়াল মানুষ তাদের ভালোবাসে যারা যুক্তিসঙ্গতভাবে তাদের অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে পারে, যারা হঠাৎ রেগে যায় না, যারা শান্তভাবে জটিল পরিস্থিতির সমাধানের চেষ্টা করে। স্যাপিওসেক্সূয়াল ব্যাক্তি বিনয়ী হয়ে থাকেন।
কেউ কেউ আছে যে স্যাপিওসেক্সূয়াল বৈশিষ্ট্যর অধিকারী কিন্তু এ বিষয়ে তার কোন ধারনা নেই। তার অনেক মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা নেই, ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা খুব কম। সাধারণত একটি ছোট বৃত্তের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে। তাই চারপাশের অনেকেই তাকে অহংকারী বলে ভুল বোঝে। এমনটা হলে তার মন খারাপ হওয়ার কোন কারণ নেই, এমন পছন্দ এবং ধ্যানে অটল থাকলে সে সম্ভাব্য স্যাপিওসেক্সূয়াল।
তাই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা নিজেদের সেপিও বলে শো অফ করছে আসলে সেপিওদের জীবনের সুখ, দুঃখ ও হতাশা নিয়ে হয়ত তাদের নূন্যতম কোন ধারণাই নেই। যারা স্যাপিওসেক্সূয়াল তাদের জীবন একই সাথে অনেক আনন্দের আবার অনেক কষ্টের হবেই অন্যান্য সাধারণ মানুষদের চেয়ে। বেশিরভাগই পেসিমিস্টিক, স্পর্শকাতর স্বভাবের হয়ে থাকে। এরা ইমোশনালি ইন্টেলিজেন্ট বেশি হলেও এদের জীবনে ভোগান্তি ও হতাশা গভীর। সবচেয়ে বড় কথা, এটা সবসময় কারো কারো জন্য স্বাভাবিক না, কারো কারো জন্য এটা ‘চয়েস’। এবং এই ‘চয়েস’ নির্ভর করে ব্যক্তির শিক্ষা, রুচি, চর্চা, পরিবেশ ও জীবনাচরণের উপর।
যারা অন্যের ব্যাক্তিগত আবেগ নিয়া হাসি ঠাট্টা করে, অন্যদের বা নিজের সংগীকেই আড়ালে বা প্রকাশ্যে ডিমরালাইজ করে, যারা সঙ্গীর সুক্ষ সুক্ষ আবেগের প্রতি সংবেদনশীল নয়, এরা আসলে স্যাপিওসেক্সূয়াল না। তাই অনেক সময় এদের কোন একটি বা দুটি বিষয় ভাল লাগলেও স্থায়ী বন্ধন তৈরি হয়না এদের সাথে।
এ সমাজে যত বেশী স্যাপিওসেক্সূয়াল থাকবে, সমাজের মানবিক সম্পর্কগুলো অনেক বিকশিত, ইতিবাচক ও বুদ্ধিবৃত্তিক হবে।
লেখনী সহযোগী: বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply