সুনামগঞ্জের প্রখ্যাত জমিদার হাছন রাজার জীবন কাহিনী আমরা যদি জানি বা সিনেমায় দেখে থাকি তাহলে হয়তো আপনি হাওরে কোনদিন ভ্রমণ না করলেও হাওরবাসীদের জীবনযাত্রার কিছু পরিচিতি পাবেন। কিভাবে হাছন রাজা মহা অত্যাচারী জমিদার থেকে গানের রাজ্যের সাধক হয়ে উঠলেন তা রীতিমত লোমহর্ষক ঘটনা।
কথিত আছে সুরমা নদীতে চলাচলকারী বিয়ের বজরায় ভয়ঙ্কর সব ডাকাতি ও নববধূ অপহরণের মাধ্যমে হাছন রাজা যে নারী ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়েছিলেন তা থেকে ছেলেকে কোনভাবেই নিবৃত করতে পারছিলেন না হাছন রাজার মা। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলে গোপনে নিজেই নববধূ সেজে বিয়ের বজরায় করে সুরমা নদী দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। যথারীতি সেই বজরায় ডাকাতি আক্রমণ হয় হাছন রাজার পাইক পেয়াদাদের দ্বারা, তারা নববধূ ভেবে রানী মাকে হাছন রাজার হেরেমে তুলে আনে। এরপর নববধূ ভেবে ছদ্মবেষী রাণী মা’র সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হবার পূর্বে ঘোমটা খুল্লে নববধুর সাজে থাকা নিজের মায়ের চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন হাছন।
কথিত আছে প্রায় এক সপ্তাহ পরে জ্ঞান ফিরলে হাছন রাজা তাঁর বিশাল জমিদারী পরিত্যাগ করেন, জীবনে আর কোনদিন নারীর সঙ্গ গ্রহণ করেননি, মায়ের মুখ পর্যন্ত আর দর্শন করেননি। জীবনের চরম আঘাতে নিজেকে আমূল বদলে ফেলেন এবং হাওরবাসীর জীবনের প্রেম, দুঃখ-সুখের গান লিখে, সুর করে আর গেয়ে গেয়ে হয়ে ওঠেন গানের ভূবনের সম্রাট।
সুনামগঞ্জ তথা বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের ঐতিহ্যের অন্যতম অংশ হাছন রাজার জীবনের বেদনাদায়ক রূপান্তরের ইতিহাসের বিপরীতে আমরা পেয়েছিলাম কিছু অমর সৃষ্টি যা বাংলা লোক সঙ্গীতের জগতে চির ভাস্মর হয়ে থাকবে। “সোনা বন্দে, মাটির পিঞ্জিরার মাঝে, একদিন তোর হইবো রে মন, লোকে বলে বলে রে, কানাই তুমি খেইর খেলাও ক্যানে” ইত্যাদি গানগুলোর কথা ও সুরে আমরা এখনো মুগ্ধ হই। এরকম চমৎকার গানের কথা ও সুরের বিপরীতে না জানি কত গল্প, কত ঘটনা দূর্ঘটনা লুকিয়ে থাকে?
গত সেপ্টেম্বর মাসে টাংগুয়ার হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশির মাঝে পর্যটক ট্রলারে ভ্রমণের সময় আমার মনের ভিতর এক অদ্ভূত গুমোট ভাব উথলে উঠছিলো। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীব বৈচিত্র্যধারী এই বিশেষায়িত অঞ্চলটিকে আমরা পর্যটনের স্থান হিসেবে বেঁছে নিলেও এই আপাত শান্ত পরিবেশ প্রতিবেশের আনাচে কানাচে না জানি লুকিয়ে আছে কতনা অজানা আনন্দ বেদনার কাব্যগাথা। হাওরের সৌন্দর্য্যে আমাদের মুগ্ধতার আড়ালে যে বঞ্চনার ও বিরূপ প্রকৃতির সাথে লড়াই করে টিকে থাকার গল্প লুকিয়ে আছে তা দেখতে অবশ্যই আপনাকে নির্মোহ গবেষকের দৃষ্টি ব্যবহার করতে হবে।
সেই গবেষণার দৃষ্টিতে যখন বিশ্লেষণ করছিলাম হাওর অঞ্চলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জীবনমানের উপর প্রভাব নিয়ে তা রীতিমত বিস্ময়কর! সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার প্রচেষ্টায় এই অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর বর্তমান জীবনযাত্রার মানে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশেষ করে অবকাঠামোর উন্নয়নের কারনে নির্দিষ্ট মৌসুমে হাওর এলাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকদের ভীড় চোখে পড়ার মত। এই পর্যটকদের আগমনে এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে খুব দ্রুত, আমরা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলাম ঘাটে ভিড়ে আছে বেশকিছু বিলাস বহুল পর্যটকবাহী বজরা। এগুলোর ভাড়া একরাতের জন্য কুড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা, এই বজরাগুলোতে অনেক ধনী ব্যক্তি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন।
আপাত দৃষ্টিতে এমন তাক লাগানো উন্নয়নের বিপরীতে কিছু পরিবেশ বিরোধী কার্যকলাপে হাওরের নির্মল পরিবেশ ধ্বংস হবার হুমকি তৈরি হয়েছে। তারমধ্যে অন্যতম হলো পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত যত্রতত্র তৈরি করা অবকাঠামোর কারনে পাহাড়ি ঢলে নেমে আসা বন্যার ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, দীর্ঘ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে মানুষের দূর্ভোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাওরের সাথে সংযুক্ত নদী ও খালগুলো হয়ে পড়ছে মৎস্য শূন্য, দূর্গম এলাকায় বন্য প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে মানুষের অতিরিক্ত চলাচল ও শিকারীদের কারনে। এই বিষয়টি উল্লেখ করে হাওর উন্নয়ন কমিটির একজন নেতার সাথে কথা বলে জানা গেলো এভাবে পর্যটনের প্রসারে এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন হলেও অদূর ভবিষ্যতে হাওরের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। তাই পরিকল্পিত পর্যটন জোন ঘোষণা করা, জলাশয়ের মৎস্য ও অন্যান্য সম্পদ সুরক্ষায় অভয়ারন্য সৃষ্টি এবং হাওরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের ঐতিহ্য রক্ষায় পর্যটকদের সচেতন করার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা আবশ্যক।
হাওরের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে গেলে আমরা যেন এর নীরবতা সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশের কথাটি মাথায় রাখি। যদিও ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারের বিকট আওয়াজে সেই নীরবতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায়। আশে পাশের পাখি বা জলের পানকৌড়িগুলো ভয় পেয়ে দূরে চলে যায়, বন্য প্রাণী ও মাছ হারায় প্রজননের অনুকূল পরিবেশ। টাঙ্গুয়ার হাওরের অন্যতম আকর্ষন শীতকালের অতিথি পাখি, কিন্তু খাবার ও জলাশয়ে জন্মানো উদ্ভিদের অভাবে সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসার পরিমাণ কমে গেছে আশংকাজনক হারে। আমরা যদি এভাবে পর্যটন বা অর্থনৈতিক লাভের কথা চিন্তা করে হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশকে হত্যা করি একদিন আর হাওর বলে কোন অঞ্চল অবশিষ্ট থাকবে না। হাওর সংরক্ষণে আমাদের সকলের আন্তরিক অনুধাবনের জায়গাটিকে প্রসস্থ করতে অন্তর্দৃষ্টির গভীর অনুসন্ধান আজ একান্তভাবে প্রয়োজন।
চলবে—————————————
পল্লব খন্দকার, ২৩ নভেম্বর ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply