২০০১ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত যশোর জেলার মনিরামপুর উপজেলায় আমি মৎস্য বিভাগের একটি প্রকল্পে কাজ করেছি। সেখানে ভবদহ নামে একটি এলাকা জলাবদ্ধতা নিরসনে খুব নামকরা টিআরএম বা টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে অনেকদিন ধরে। এই প্রকল্পটি আরম্ভ হবার পূর্বে অত্র এলাকার প্রায় ১০০ টিরও বেশি গ্রাম বর্ষা মৌসুমে পানির নীচে তলিয়ে থাকতো। এলাকার মানুষ কৃষি ফসল বিশেষ করে ধান উৎপাদন করতে না পারায় চরম অভাবের মধ্যে দিনাতিপাত করতো। কিছু কিছু স্থানে এই জলাবদ্ধতা প্রায় সারা বছর ধরেই থেকে যেতো, আর কিছু কিছু গ্রামের অংশে শুধুমাত্র চার থেকে পাঁচ মাস শুকনা থাকতো। বর্ষা মৌসুমে প্রায়ই পাকা রাস্তা ডুবে যেতে দেখতাম, এলাকার সবার মাছের খামার ভেসে গিয়ে একাকার হয়ে যেতো।
আমরা জানি যশোর অঞ্চলটি সমূদ্রসীমা হতে দেশের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত। তাই এই অঞ্চলের মানুষ সেখানকার প্রবাহিত জোয়ার ভাটার নদীতে পলি ভরাটের কারনে কপোতাক্ষ ও ভৈরব নদে পানি নামতে না পারায় দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতার কারনে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় দূর্বল ছিলো। যদিও পরবর্তীতে ধানের জমিতেই মাছের খামার বা ঘের স্থাপন করে গলদা চিংড়ি চাষের প্রচলন ঘটিয়ে কিছুটা অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখতে পায় কিন্তু প্রতি বছর বন্যায় খামার ভেসে যাওয়ায় সেই উন্নয়ন টেকসই হতো না। এই জলাবদ্ধতার সময়ে খাদ্য নিরাপত্তা, হাইজিন ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কবলে পড়ে মানুষ চরম দূর্ভোগের শিকার হয়েছে। ভবদহ এলাকাটি বেশ কয়েকটি বিল ও প্লাবনভূমির সমন্বয়ে গড়ে ওঠায় আমি নিজেই দেখেছি অতিরিক্ত বন্যায় সৃষ্ট দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতায় মানুষ গবাদি পশুর সাথে উঁচু স্থানে বা রাস্তার পাশে দিনের পর দিন বসবাস করেছে।
যশোর অঞ্চলে আর একটি নামকরা জলাশয়ের নাম বাঁওড়। আমরা অনেকেই বাঁওড় ও হাওরের পার্থক্য বুঝতে পারি না। বাঁওড় আসলে মরা নদীর বাঁকানো অংশ, দুই চারশো বছর আগে এসব নদী চলমান ছিলো, সময়ের পরিক্রমা এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কারনে নদীটির ঘোড়ার খুরের মতো বাঁকানো অংশটি মরে গিয়ে নদীটি সোজাভাবে প্রবাহিত হয়। সেই মরা অংশটিই বাঁকা ওড় বা বাঁওড় নামে একটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়ে যায়। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের হাওর এলাকাটি ভৌগলিক অবস্থানগত কারনেই অনেক নীচু এবং বিশাল একটা এলাকা জুড়ে নীচু হওয়াতে বর্ষা মৌসুমে পানি জমবে, সাত আট মাস ফসল ফলানো যাবে না এসব তথ্য ঐ এলাকার মানুষ জন্ম থেকেই দেখে থাকে এবং শুধুমাত্র শুকনা মৌসুমে ফসল উৎপাদনের পরিকল্পনা করে। তাই বৃহত্তর সিলেটের হাওর ও যশোরের ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধ মানুষের জীবনচিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। দুই অঞ্চলের উন্নয়ন বিজ্ঞান ও প্রকল্প বাস্তবায়নের গল্পগুলোও তাই পুরোপুরি ভিন্ন।
প্রশ্ন হলো এইরকম দীর্ঘমেয়াদী জলাবদ্ধতা বা ভৌগলিক কারনে নীচু এলাকাগুলোর মানুষ কেনো বারংবার দূর্ভোগের শিকার হয়? এসব এলাকার মানুষের দারিদ্রতা কেনো নিরসন করা সহজ নয়? সরকার ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো বছরের পর বছর হাজারো প্রকল্প বাস্তবায়ন, রিলিফ বিতরন, অনুদান প্রদান করেও কেনো উন্নয়নের এতো ধীর গতি? আমরা যদি একটু খেয়াল করি পৃথিবীর কিছু কিছু দেশ জলাবদ্ধ এলাকা বা সমূদ্রসীমা থেকে নীচু এলাকাগুলোতে এমনভাবে সুযোগ সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে যা পরবর্তীতে স্থায়ী পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে। সেসব জলমগ্ন এলাকাগুলোর সবটুকু প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রেখে অন্যান্য প্রাণী বা উদ্ভিদের আবাসস্থল সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়। নেদারল্যান্ডস, ইতালীর ভেনিস শহর, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বেশ কয়েকটি দেশের পর্যটন শিল্প বিকশিত হয়েছে এই জলমগ্নতার উপর ভিত্তি করে। আমাদের দূর্বলতার স্থানটি এখানেই, সক্ষমতা ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনার অভাবে শুধুমাত্র ক্ষুদ্র চোখে আপাত সমাধানের রাস্তায় হাঁটাই আমাদের প্রধান অন্তরায়।
অন্যান্য দেশ যেখানে দূর্যোগকে সম্পদে পরিণত করে থাকে আমরা সেটাকে পয়সা কামানোর ধান্দা হিসেবে নিয়ে সমস্যা জিইয়ে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। আবার রাস্তাঘাট উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক পরিবেশের দিকে একটুও খেয়াল রাখি না, উন্নয়নের দোহাই দিয়ে নির্বিচারে ধ্বংস করি জীব বৈচিত্রের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত প্রাণি ও উদ্ভিদের আবাসস্থল। ফলে একদিকে উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও তা নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি করে। মানুষের সুবিধা তৈরি করতে গিয়ে অনেক প্রাণি ও উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন হয়ে সার্বিক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে।
তাই হাওর সহ সকল প্রাকৃতিক জলাধার উন্নয়নের সময় প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করতেই হবে। গত সেপ্টেম্বরে আমার হাওর ভ্রমণের সময় প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস হবার মতো অনেক কিছুই চোখে পড়েছে। প্রথমত ভরা মৌসুমেও বাজারে হাওরের মাছ শূন্যতা, স্থানীয় বিভিন্ন বন্য প্রাণি ও পাখির আকাল, হিজল-করচ গাছের অভাব খুবই বেদনাদায়ক ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। হাওর অঞ্চলে অবকাঠামোগত উন্নয়নে হয়তো পর্যটন ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠবে, স্থানীয় মানুষের দূর্ভোগ লাঘব ও অর্থনীতির প্রসার হবে কিন্তু প্রাকৃতিক পরিবেশ ধবংশপ্রাপ্ত হয়ে বিরান এক ক্ষেত্র হিসেবে ইটকাঠ পাথরের কৃত্রিম জনপদ হয়ে একদিন নিক্ষিপ্ত হবে ইতিহাসের ভাগাড়ে।
চলবে—————————————
পল্লব খন্দকার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply