আমি দক্ষিন বঙ্গের মানুষ, আরো স্পষ্ট করে বললে বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে আমার গ্রামের বাড়ি। সৌভাগ্যবশতঃ আমার শৈশব কেটেছে গ্রামে তাই নদী, নালা, খাল, বিল সংক্রান্ত অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলেও আমার পঞ্চাশ পেরুনো জীবনে হাওর দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি এতোটা দিন। ভরা বর্ষা মৌসুমে আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বহমান চিত্রা নদীর পানি টইটুম্বুর হয়ে ভরে যেতে দেখেছি, যদিও কখনো উপচে পড়ে বন্যার সৃষ্টি হতে দেখিনি। তবে ভরা নদীর চেহারায় একটা আগ্রাসী ভাব আমরা বুঝতে পারতাম। বেশ স্রোত থাকতো, কোন কোন বছর কচুরীপানায় ভরে যেতো। খুব বেশী বৃষ্টি হলে ধান ক্ষেতে হাটু পানি জমে যেতো আর একটু নিচু এলাকায় ধান ডুবে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হতো তবে প্রতি বছর নয়। বন্যায় আমাদের গ্রামের বাড়ি ডুবে যাওয়া বা পুকুর ভেসে যেতে দেখিনি কোনদিন।
তাই হাওর আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা, দূর্ভাগ্যবশতঃ অল্প কয়েকবার সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ভ্রমণের সুযোগ হলেও বর্ষাকালে ভরা মৌসুমে হাওরে যাওয়া হয়নি কখনো। একবার একটি জরীপের কাজে কিশোরগঞ্জ ও হবিগঞ্জ গিয়েছিলাম শুষ্ক মৌসুমে, তাই বিস্তৃত জলরাশি দেখার সুযোগ পাইনি। দীর্ঘদিন ধরে ইচ্ছে ছিলো হাওর ভ্রমণের কিন্তু আমরা ডাঙ্গা এলাকার মানুষ বিধায় বিস্তীর্ণ জলরাশির ব্যাপারে একটা ভয়ও ছিলো। তবে সম্প্রতি গত সেপ্টেম্বর মাসে সুযোগ হলো হাওর পরিদর্শণ ও নৌ ভ্রমণের। হাওর বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা না থাকায় অনেক পাঠকেরও হয়তো কৌতুহল থাকতে পারে হাওর কি? হাওর মূলত বিস্তৃত প্রান্তর, অনেকটা গামলা আকৃতির জলাভূমি যা প্রতিবছর মৌসুমী বৃষ্টির সময় পানিপূর্ণ হয়ে উঠে। সমগ্র বর্ষাকাল জুড়ে হাওরের পানিকে সাগর বলে মনে হয় এবং এর মধ্যে অবস্থিত গ্রামগুলোকে দ্বীপ বলে প্রতীয়মান হয়। বছরের সাত আট মাস হাওরগুলো পানির নিচে অবস্থান করে।
বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি হাওরের মধ্যে নামকরা ও সবচেয়ে বড় হাওরটি সুনামগঞ্জে অবস্থিত, এটির নাম টাংগুয়ার হাওর। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা এবং তাহিরপুর উপজেলাস্থিত জীববৈচিত্রে সমৃদ্ধ মিঠা পানির এ হাওর বাংলাদেশের ২য় রামসার এলাকা। ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া, জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে সারি সারি হিজল-করচ শোভিত, পাখিদের কলকাকলি মুখরিত টাংগুয়ার হাওর মাছ, পাখি এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর এক বিশাল অভয়াশ্রম। বর্তমানে মোট জলমহাল সংখ্যা ৫১টি এবং মোট আয়তন ৬,৯১২.২০ একর। তবে নলখাগড়া বন, হিজল করচ বনসহ বর্ষাকালে সমগ্র হাওরটির আয়তন দাড়ায় প্রায় ২০.০০০ একর। আমি হাওর ভ্রমণে গিয়েছিলাম একটি গবেষণা দলের সাথে, সেজন্যই টাংগুয়ার নিয়ে কিছু তথ্য উপাত্ত জেনে নিতে হয়েছিলো।
যদিও এ বছর দেরীতে বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার অনুপস্থিতির কারনে হাওরের ভয়ঙ্কর রূপটির নাকি দেখা আমরা পাইনি। বরং আমাদের ট্রলার যখন হাওরের মধ্যে দিয়ে চলছিলো কিছু জায়গায় পানির তলদেশের শ্যাওলাগুলো দেখা যাচ্ছিলো। এরপর জানতে পারলাম এবার মাছের পরিমাণও অন্যান্য বছরের তুলনায় কম। এর কারন হিসেবে স্থানীয় মানুষের ভাষ্য হলো দেরীতে বৃষ্টি আসায় প্রজনন মৌসুমে মাছ হাওরে উঠে আসতে পারেনি। এ কথার যুক্তি হলো পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানিতে হাওর এলাকার নদী, খাল, বিল সহ সকল প্রাকৃতিক জলাধারগুলো অথৈ জলরাশিতে একাকার হয়ে যায়। প্রজনন মৌসুমে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়াতে মাছের বংশ বিস্তার কম হয়েছে, এর প্রমাণ তাহিরপুর উপজেলার মাছের বাজারেও পেলাম। হাওর ভর্তি পানি অথচ বাজারে দেখলাম চাষের পাঙ্গাস, তেলাপিয়া আর রুই কাতলা মাছের প্রাচুর্য।
তবে রাস্তাঘাটের উন্নয়নের ফলে বর্তমানে হাওরবাসীদের পূর্বের চেয়ে কম দূর্ভোগ পোহাতে হয়। যদিও জানলাম গত বছর হঠাৎ করে আসা পাহাড়ী ঢলে টাংগুয়ার হাওর এলাকার অধিকাংশ মানুষের বাড়ি ডুবে গিয়েছিলো। কিছু রাস্তা দেখলাম পূনঃমেরামত করা হয়েছে, সেগুলো নাকি পাহাড়ী ঢলে পুরোপুরি বিধবস্থ হয়েছিলো। আরো একটি মজার রাস্তা দেখলাম হাওরে, দেখি ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা চলছে হাওরের পানির মধ্য দিয়ে, কৌতুহলী প্রশ্নের জবাব পেলাম সেগুলো সাব-মার্জিবল রাস্তা। হাওর এলাকায় শুকনা মৌসুমে মানুষের যোগাযোগের জন্য এইরকম রাস্তা তৈরি করা হয়েছে যাতে ভরা মৌসুমে পানি প্রবাহ আটকে গিয়ে বন্যা সৃষ্টি না হয়।
হাওরের বসবাসের ঘরবাড়িগুলো যেখানে নির্মান করা হয় সেগলো আঁটি নামে পরিচিত। সাধারণত যে উচ্চতায় পানি থাকে হাওরে তারচেয়ে উচু করে মাটি ভরাট করে, বাঁশ বা সিমেন্টের খুঁটির মাধ্যমে পানির তোড় থেকে রক্ষার জন্য আঁটি নির্মান করা হয়। ভরা মৌসুমে এই ছোট ছোট আঁটিতে বসবাস করা আট দশটি পরিবারের যোগাযোগের জন্য একমাত্র ভরসা নৌকা বা ট্রলার। আমাদের মতো ডাঙ্গার মানুষদের কাছে হাওরবাসীর এই সীমাহীন অসুবিধার ব্যাপারটি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। যেকোন জরুরী পরিস্থিতিতে নৌকাযোগে দূর এলাকায় পৌঁছাতে চার পাঁচ ঘন্টাও লেগে যায়। এছাড়া প্রবল ঝড় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগে তারা বিপদগ্রস্থ হলে খুব সহজে সাহায্য সহযোগিতা পায় না। যুগের পর যুগ অবহেলিত এলাকা হিসেবে হাওরবাসী দিনযাপন করলেও ইদানীং বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নের সুফল পেতে আরম্ভ করছে তারা।
যদিও আমি স্পষ্ট খেয়াল করেছি প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মীগণ কেউই সময়মতো অফিস করেন না। এমনও শুনতে পেলাম কিছু দপ্তরের কর্মকর্তাগণ শুধুমাত্র বেতনের সময় অফিসে আসেন আর মাসের বাকী দিনগুলো পরিবারের সাথে জেলা শহরেই বসবাস করেন। সেই হিসাবে বলা যায় এই অঞ্চলের মানুষগুলো এখনো বঞ্চনার মধ্যেই বসবাস করছেন। আসলে ভূ-প্রকৃতিগত কারনে এখানে স্থায়ীত্বশীল অবকাঠামো টিকিয়ে রাখাও একটি কঠিন সমস্যা। সেকারনে একটু উন্নত জীবনে অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে এতোটা পশ্চাদপদ ও প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থান করা সম্ভবপর হয় না।
চলবে—————————————
পল্লব খন্দকার, ২৯ অক্টোবর ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
হাওরের গ্রাম
Leave a Reply