আমি মধু প্রেমিক! বিভ্রান্তির কিছু নেই, মৌমাছির চাক ভাঙ্গা মধুর প্রেমিক যে কেউ হতেই পারেন। তবে ব্যর্থ প্রেমের ক্ষেত্রে যেমন ছ্যাকা খাওয়ার সম্ভাবনা আছে তেমনি মধু প্রেমিক হলেও আপনি ছ্যাকা খেতে পারেন। আমি বহুবার ১০০ ভাগ খাঁটি মধুর ছ্যাকা খেয়েছি, বিশেষ করে সুন্দরবনের খাঁটি মধু বলে যেগুলো বাজারে বিক্রি হয় তা আদৌ কতটুকু খাঁটি তা বোঝার সক্ষমতা আমাদের নেই সেকথা আমি হলফ করে বলতে পারি।
আমার অভিজ্ঞতা যদি বলি তাহলে গ্রামে শৈশব কাটানোর কারনে বাড়ির গাছে বা টিনের চালের ঢাপে মৌমাছির বাঁধা চাক ভাঙ্গা মধু খাবার অসংখ্য অভিজ্ঞতা আছে। তাই খাঁটি মধুর স্বাদ কেমন হবে সেটি এক ফোটা মুখে দিলেই আমি নিশ্চিত হতে পারি এখনো। আমার মত অনেকেই তা পারেন, এমনকি কোনটি বন্য মৌমাছির মধু আর কোনটি খাঁচায় চাষ করা মৌমাছির মধু সেটাও অনায়াসে বোঝা সম্ভব। কিন্তু ঝামেলা হচ্ছে আমাদের শৈল্পিক মধু বিক্রেতাগণ চাকের মধ্যে এমনভাবে মধু ঢুকিয়ে এলুমিনিয়ামের হাড়ি বা বালতিতে ফেরি করে মধু বিক্রি করেন আপনি বিভ্রান্ত হতে বাধ্য হবেন, ভাববেন এই বুঝি সদ্য চাক ভেঙ্গে খাঁটি মধু নিয়ে হাজির লোকটি। সেই মধুর রসের ভিতর দেখতে পাবেন কিছু মৃত বা অর্ধমৃত মৌমাছি পর্যন্ত, অবিশ্বাস করার সুযোগই পাবেন না। আপনি মহা আনন্দে তা কিনে নিয়ে আরামে খেতে খেতে একটু অন্যরকম স্বাদ লাগলেও ভাববেন- আহা, গ্রামের চাক ভাঙ্গা খাঁটি মধু বলে কথা!
বাস্তবতা হলো এইভাবে যারা চাকসহ ফেরি করে মধু বিক্রি করে বেড়ান তাদের নব্বই ভাগ খাঁটি মধুর নামে মানুষকে চিনি ও ডালডা জাতীয় উপাদানের মিশ্রণ সরবরাহ করেন! একেকজন একেক অনুপাতে মিশিয়ে সামান্য মধু দিয়ে সুবাসটা রাখার অপচেষ্টা করেন এবং বাকী উপাদান হিসেবে কেউ কেউ বিভিন্ন রঙও মিশ্রণ ঘটিয়ে থাকেন। যে দেশে শিশু খাদ্য, রূপচর্চার প্রসাধনী থেকে গাড়ির ইঞ্জিন পর্যন্ত নকল করার ইঞ্জিনিয়ারগণ ভুরি ভুরি পরিমাণে আছেন সেদেশে সামান্য মধু বানাবার হরেকরকম প্রযুক্তি মোটেও দুষ্প্রাপ্য নয়। এমনতর নীতি নৈতিকতাহীন প্রযুক্তিবিদদের ঠেলায় আপনার পক্ষে আসল নকল খুঁজে বের করা ভীষণ দুরূহ ব্যাপার।
অনেকেই ঠান্ডাজনিত এলার্জি, কাশি, হাচি বা এজমা রোগের উপশমের প্রয়োজনে কবিরাজের পরামর্শে নিয়মিত মধু সেবন করেন। দেশের বিভিন্ন নামকরা ঔষধ কোম্পানি মধু ব্যবহার করে কাশির সিরাপ থেকে শুরু করে অনেক ধরনের ঔষধের কাঁচামাল হিসেবে মধু ব্যবহার করে থাকে। এসকল কোম্পানির নিজস্ব মান নিয়ন্ত্রণ ল্যাবরেটরি থাকায় আসল নকল খুঁজে হয়তো সঠিক মানের মধু তারা সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু আমাদের মতো ঢাল তলোয়ারহীন জনতার একমাত্র অস্ত্র চোখের দেখা ও চেখে দেখা, কিন্তু মধু নির্মান প্রযুক্তিবিদগণ এতোটাই স্মার্ট যে আপনার কোন সাধ্য নেই এইভাবে পরীক্ষা করে আসল নকলের পার্থক্য নির্ণয় করা। আমি বহুবার অনেক বুঝে শুনে দেখে চেখে মধু কিনেও ঠকে গেছি।
সমস্যা হলো শুধু চিনি মেশালেও আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি অতোটা হবে না কিন্তু তারা মধু খাঁটি প্রমাণে এমন কিছু রাসায়নিক যুক্ত করে যার ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে সুদুর প্রসারী হবে। এছাড়া আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি মধু যত পুরাতন হবে এর কার্যকরিতা তত বেশী হবে বা মধু নিজেই একটি প্রিজারভেটিভ, তাই এটি হাজার বছরেও নষ্ট হয় না। আসলে আমরা অধিকাংশ ভোক্তারা জানি না মধুতে কতভাগ জলীয় কণা থাকলে এটি দীর্ঘদিন সংরক্ষণের উপযুক্ত থাকে। মধুতে যদি ১৮% জলীয় কণা থাকে তাহলে সেটি সর্বাধিক সময়ের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে, এক্ষেত্রে কোনভাবেই ২০% এর অধিক জলীয় কণা থাকা মধু ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় দুই মাসও গুণাগুণ অটুট থাকতে পারে না। মধুর খাঁটিত্ব অনেকাংশেই এই জলীয় কণার পরিমানের উপর নির্ভরশীল তাই যারা মধু কোনধরনের প্রক্রিয়াজাত করা ছাড়াই বাজারে নিয়ে আসে বা জলীয় কণার পরিমাণ কমানোর সঠিক পদ্ধতি জানেন না তাদের কাছ থেকে ভালো মানের মধু পাওয়া সম্ভব নয়।
তাহলে উপায়?
চাক ভাঙ্গা মধু বা খাঁচায় উৎপাদিত মধুতে সাধারণত শতকরা ২৫ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত ময়েশ্চার বা জলীয় কণার অংশ থাকে। এই জলীয় অংশ কমানোর জন্য নানারকম প্রচলিত বা আধুনিক পদ্ধতি ও মেশিনারি আছে, তাই বানিজ্যিকভাবে যারা উৎপাদন করেন বা মধু প্রক্রিয়াজাত করেন তাদের নিকট থেকেই মধু ক্রয় করা উচিত। অবশ্য চিনি, চর্বি ও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানে তৈরি মধু কোনভাবেই কেনা যাবে না। অর্থাৎ খোলা বাজারে সুন্দরবনের খাঁটি মধু বলে যতোই মনোহরী বিজ্ঞাপন দেয়া হোক, অথবা গ্রামে বা শহরে ফেরি করে চাক ভাঙ্গা মধু বলে বিক্রি করা মধু কিনে আপনি প্রতারিত হবার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ ভাগ। শুধুমাত্র আপনি যদি নিজের উপস্থিতিতে চাক ভাঙ্গিয়ে অথবা খাঁচায় চাষ করা মধুর উৎস্য থেকে নিজে দাঁড়িয়ে সংগ্রহ করতে পারেন তাহলে মোটামুটি নিশ্চিত হবার সম্ভাবনা থাকে। যদিও খাঁচায় চাষ করা মৌমাছিকে খাদ্য হিসেবে অনেক খামারী চিনি বা গুড় সরবরাহ করেন, তাই খাঁটি মধুর নিশ্চয়তা পাওয়া এতো সহজ কথা নয়।
আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় মধু বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, মধুকে মুসলিমদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন ও হাদিসে অনেক উপকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেই মধু আমাদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক স্বার্থের বলী হয়ে ভেজালে ভেজালে সয়লাব হয়ে যাওয়ায় আসল নকল কিছুতেই নির্ণয় করা সম্ভবপর নয়। আমাদের দেশের মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে লাভ নেই, কারন খাদ্যে ভেজাল দেয়া ও ওজনে কম দেয়া ব্যক্তি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে একথা খুব জোর দিয়েই বলা হয়েছে সকল ধর্মের মূল কথায়। এদেশে ধর্মের লেবাসধারী অনেক ব্যক্তি ঘুষ নেয়াটাকে জায়েজ মনে করে এবং ঘুষের টাকায় মসজিদ মন্দির গির্জাও প্রতিষ্ঠিত করে থাকে। তাই একমাত্র আমাদের সচেতন হওয়া ব্যতীত মধু বা অন্যান্য খাদ্যে ভেজালকারিদের হাত থেকে রক্ষা পাবার উপায় নেই। ব্র্যান্ডের মধু কিছুটা হলেও বিশ্বাস করা যায় কিন্তু খোলা বাজারের মধুকে আপনি অর্ধেক বিষ হিসেবে ধরে নিতে পারেন। কারন মধুতে যদি জলীয় কণা বেশী থাকে তা বেশিদিন সংরক্ষণ করা হলে সেখানে নানান ধরণের ফাঙ্গাস ও ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। এরকম ক্ষেত্রে যেকোন সময় খাদ্য বাহিত বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে, এছাড়া রাসায়নিক মিশ্রিত মধু পান করলে ক্যান্সারসহ কিডনি রোগের প্রাদূর্ভাব ঘটতে পারে।
পল্লব খন্দকার, ২১ নভেম্বর ২০২৩।