ভরা বর্ষায় অথবা ভরা পূর্ণিমায় হাওরের রূপমাধূর্য্যের সুধা উপভোগ করতে বজরা নৌকা বা ট্রলারে রাত্রিযাপন করেন অনেক পর্যটক। একটি পর্যটক গ্রুপে অনেকে থাকায় হাওরের নীরবতা কতটা উপভোগ্য হয় তা পর্যটকদের চাহিদার উপর নির্ভরশীল। যারা চাইবেন রাতের নীরবতা উপভোগ করতে তারা হয়তো নিজস্ব কিছু আয়োজন করে থাকেন আর যারা হৈ-হুল্লোড় দলের তাদেরও থাকে ভিন্ন কিছু আয়োজন। আমার হাওরে রাত্রিযাপনের সুযোগ হয়নি তবে সুন্দরবনের খালের ভিতর লঞ্চে রাত্রিযাপন করেছি, সেখানে রাতের বেলায় কোনভাবেই বাইরে বের হবার নিয়ম নেই, শব্দ করা নিষেধ, নিরাপত্তা রক্ষীরা সারারাত পাহারা দেয় বাঘ মামা যাতে লঞ্চে হানা না দেয়। অনেকটা খাঁচায় বন্দী প্রাণীর মতো রাত্রিযাপন কিন্তু হাওরের রাত সম্পূর্ণ ভিন্ন হবারই কথা। হাওরে হিংস্র প্রাণীর মধ্যে শুধুমাত্র সাপের উপদ্রব হতে পারে কিনা আমার ধারনা নেই কারন পানিতে থাকা অধিকাংশ সাপ খুবই নির্বিষ।
তবে হাওরে বৃষ্টি ও বাতাসের তীব্রতা অনেক সময় বিপদজনক ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে যার সাথে আমাদের মতো অনেকের পরিচয় না থাকলে ভীতিও ছড়াতে পারে। তাই আমার কাছে হাওরে রাত্রিযাপনের জন্য পূর্ণিমা রাত সবচেয়ে প্রার্থনীয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে আমার সাথে গবেষণা দলের একজনের ভরা পূর্ণিমা রাতে হাওরে রাত্রিযাপনের অনেক পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো। তাঁর বর্ণনা থেকে যেটুকু ধারনা পেলাম তাতেই শিহরিত হয়ে উঠছিলো মন, স্থলভাগেই ফাঁকা ময়দানে ভরা পূর্ণিমার রাত যে মায়াবী ও রোমান্টিক পরিবেশ তৈরি করে আর সেখানে ধু ধু জলরাশির মৃদু ঢেউয়ের উপর চাঁদের আলোর ঝিলিমিলি ঝিলিক কতটা মোহনীয় হতে পারে ভাবা যায়? একটু বাউলা বা ভাবুক স্বভাবের কেউ হলে আপনি নিশ্চিত অন্য কোন জগতের সন্ধান পেয়ে যাবেন! কবি স্বভাবের হলে নিশ্চিত কবিতা প্রসব হতে থাকবে আর যদি নীরবে উপভোগ করতে চান দেখা যাবে নিজের অজান্তেই এতো সৌন্দর্য্য দেখে দু চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠেছে।
হাওরের পর্যটকবৃন্দের এরূপ অপার্থিব আনন্দ উপভোগের যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করতে হলে আমাদের হাওরের বৈশিষ্ট্যও রক্ষা করতে হবে। সাময়িক সমস্যার সমাধানের উপর গুরুত্ব না দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হবে গবেষক, প্রকৌশলী ও উন্নয়ন কর্মীদের। হাওরের আদিরূপ অক্ষুণ্ণ রেখে যাবতীয় উন্নয়নের ডিজাইন অনুমোদন দিতে হবে অন্যথায় ইতিমধ্যে হাওরের অবিচ্ছেদ্য অংশ বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ ও তাদের প্রতিবেশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে তা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
পৃথিবীর সব দেশেই তাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে ও পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পর্যটন বা অন্যান্য উন্নয়নের সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে থাকে। হাওর অঞ্চলটি এমনই একটি ভৌগলিক সৃষ্টি যার সাথে বহুবিধ পরিবেশের উপাদান সম্পৃক্ত। এখানে মানুষ, ফসল, মাছ, গাছ, পাখি সবাইকে রক্ষা করেই উন্নয়নের রাস্তায় জল ও স্থলের মধুর সম্মিলন ঘটাতে কাজ করা একান্ত প্রয়োজন। যদিও বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্ন, হাওরবাসীর দূর্দশা লাঘবের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে অধিকাংশ বৃহৎ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে বর্তমানে। তন্মধ্যে কিশোরগঞ্জের অল ওয়েদার সড়কটি পর্যটকদের খুব টানছে, দলে দলে সবাই ছুটছে সেখানে। কিন্তু পাহাড়ি ঢলের সময় উজান থেকে নেমে আসা অতিরিক্ত পানির চাপ আর কি কি ক্ষতি করতে পারে সেটি এখুনি বোঝা যাবে না। বন্যার পানি নিষ্কাশনে বিলম্ব, নতুন নতুন এলাকায় বন্যার আক্রমণ ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতার মতো গুরুতর সমস্যাগুলো সামনের দিনে কতটা সমস্যায় ফেলতে পারে সেটাও আমাদের হিসাবে রাখতে হবে।
হাওরবাসীর উন্নত জীবন যাপনের অধিকার যেমন রক্ষা করার তাগিদ রয়েছে পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশ রক্ষার দায়িত্বও আমাদের সুষ্ঠভাবে পালন করতে হবে। এই ব্যাপারটি আমাদের দেশে উপেক্ষিত থেকে যায়, নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করে নতুন নতুন প্রাকৃতিক দূর্যোগ ডেকে আনার মতো বিড়ম্বনা আর কিছু নেই। তাই উন্নয়ন হতে হবে সমন্বিতভাবে, সবদিক রক্ষা করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা থাকলে বড় ধরণের প্রাকৃতিক বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব এবং হাওরকেও একইসাথে উন্নয়ন ও পর্যটনের উর্বর ক্ষেত্র হিসেবে প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।
(সমাপ্ত)
পল্লব খন্দকার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply