সভ্যতার প্রয়োজনে নগরায়ন অনিবার্য ছিলো এই কথাটি যেমন সত্য তেমনি নগরে বসবাসকারী মানুষেরা দিনে দিনে প্রত্যাশার উচ্চমার্গে পৌঁছাতে গিয়ে শীর্ষ বিন্দুতে বোধহয় পৌঁছে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে। মূল সমস্যাগুলো দেখা যাচ্ছে যে, সম্পদ অর্জনের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে যখন সফলতার ভান করছে তখন সুক্ষ বিচারে দেখতে পাচ্ছে আসলে তার একান্ত নিজস্বতা হারিয়ে গেছে, সে এখন মেকি চাকচিক্যের দুনিয়ার সম্রাট! আসলে সবাই তার সাফল্যের স্তাবক, এখুনি তাকে সাফল্যের চূড়া থেকে নিক্ষেপ করা হলে সঙ্গী হিসবে আশেপাশে আর কাউকেই খুঁজে পাবে না!
অনেক দেখেছি, প্রচুর দেখছি, সফলদের দেখছি, ব্যর্থদের দেখছি। দৌড় দৌড় দৌড়, সম্পদের মোহে, খ্যাতির মোহে। কতোনা ছলা-কলা, মিথ্যার ফুলঝুরি, অহমিকা, অকারণ আস্ফালন, মহা ব্যস্ততা, সময়ের বড্ড অভাব, মিটিং আর মিটিং, কর্পোরেট দুনিয়ায় অবগাহন। সেই ২৪-২৫ থেকে শুরু, প্রতিযোগিতায় সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা, ভয়ডরহীন যৌবনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, ফিরে তাকানোর সময় নেই, কে এলো কে গেলো কে রাখে খবর? ক্যারিয়ার এর বলগা হরিণ ছুটিয়ে সবাইকে পরাজিত করে জয়ী হও মানুষ তুমি কি সত্যিকারের মানুষ?
এরপর এলো পড়ন্ত বেলা, খ্যাতির শীর্ষ বিন্দুর পরই তো পতনের লাল সঙ্কেত, হঠাত করেই অচেনা অনুভব শরীরে ও মনে, অনেক কিছুই করতে চাইলেও শরীর বিদ্রোহ করছে, নতুন স্বপ্নের কথা শোনালে ঘনিষ্ঠজনেরাও মুখ টিপে হাসছে! সময় শেষ, দেহের বয়স তো বাড়ে কিন্তু মনের ঠিক কতটা, শৈশবের যৌবনের স্মৃতিগুলো ধেয়ে ধেয়ে আসে, শুধুই নিজের জন্যই করলাম, নিজেকে অনেক বড় বানালাম, নিজের নামে অনেক ধন সম্পদ গড়লাম। এখন? এরপর গন্তব্য কোথায়? আমরা কি জানি না? নিশ্চয়ই জানি, কিন্তু স্বীকার করি না যতদিন শরীরের ত্বক থাকে টান টান, পক্ককেশ ঢেকে রাখি কালো মিথ্যার আবরণে। হায়রে দৌড়ের জীবন, এক নিমেষেই শেষ? এখন শুধু অপেক্ষা, বৃদ্ধ হয়ে সম্পদের পাহাড়ে ঢুলে ঢুলে একদিন খাটিয়ায় উঠে চিরতরে অন্তর্ধান! হলো তো রে মানুষ? গত পঞ্চাশ বছর ধরে অনেক দেখেছি, এখনো দেখছি।
শুধু নিজের জন্য না, আগামী প্রজন্মের জন্য বেঁচে থাকা বা বসবাসযোগ্য করতে নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার মন্ত্রটা আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত না। সারা জীবনে হিসেবী কামাইয়ের কয়েক থেকে কয়েকশো কোটি টাকার মালিক, ফ্লাট, গাড়ি-বাড়ি এসব ঠিক কতটা সুখের নিশ্চয়তা দেয় সে হিসাব আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কুলাতে পারে না তবে বেহিসেবী দানের মধ্যে যে অনির্বচনীয় সুখের নিশ্চয়তা আছে তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমার লেখার শিরোনামে যে প্রশ্ন দুটো করেছি সেই দুটির সমাধানে তাই কিছু করতে মন চায়, শহরের মৃত ভূখন্ড ছেড়ে জীবনের প্রারম্ভের সেই “আমাদের গ্রাম আমাদের জীবন” গ্রহের উন্নয়নের নেশায় বুদ হয়ে ভাবি-
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;
মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি
মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,
মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভাইয়ের স্নেহের ছায়,
তুমি যাবে ভাই – যাবে মোর সাথে, আমাদের ছোট গাঁয়,
ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,
কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া;
ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী
পারের খবর টানাটানি করি;
বিনাসুতি মালা গাথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;
বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তটের হিয়া।
তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে, ছোট সে কাজল গাঁয়,
গলাগলি ধরি কলা বন; যেন ঘিরিয়া রয়েছে তায়।
সরু পথ খানি সুতায় বাঁধিয়া
দূর পথিকেরে আনিছে টানিয়া,
বনের হাওয়ায়, গাছের ছায়ায়, ধরিয়া রাখিবে তায়,
বুকখানি তার ভরে দেবে বুঝি, মায়া আর মমতায়!
তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে – নরম ঘাসের পাতে
চম্বন রাখি অধরখানিতে মেজে লয়ো নিরালাতে।
তেলাকুচা – লতা গলায় পরিয়া
মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,
হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,
তোমার গায়ের রংখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী।
মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া
তোর সনে দেই মিতালী করিয়া
ঢেলা কুড়িইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি,
সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।
তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর লতার সনে,
সীম আর সীম – হাত বাড়াইলে মুঠি ভরে সেই খানে।
তুমি যদি যাও সে – সব কুড়ায়ে
নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,
খাব আর যত গেঁয়ো – চাষীদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,
হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব দুইজনে।
তুমি যদি যাও – শালুক কুড়ায়ে, খুব – খুব বড় করে,
এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে,
কারেও দেব না, তুমি যদি চাও
আচ্ছা না হয় দিয়ে দেব তাও,
মালাটিরে তুমি রাখিও কিন্তু শক্ত করিয়া ধরে,
ও পাড়ার সব দুষ্ট ছেলেরা নিতে পারে জোর করে;
সন্ধ্যা হইলে ঘরে ফিরে যাব, মা যদি বকিতে চায়,
মতলব কিছু আঁটিব যাহাতে খুশী তারে করা যায়!
লাল আলোয়ানে ঘুঁটে কুড়াইয়া
বেঁধে নিয়ে যাব মাথায় করিয়া
এত ঘুষ পেয়ে যদি বা তাহার মন না উঠিতে চায়,
বলিব – কালিকে মটরের শাক এনে দেব বহু তায়।
খুব ভোর ক’রে উঠিতে হইবে, সূয্যি উঠারও আগে,
কারেও ক’বি না, দেখিস্ পায়ের শব্দে কেহ না জাগে
রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে
ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;
কাদার বাঁধন গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগে ভাগে
সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।
ভর দুপুরেতে এক রাশ কাঁদা আর এক রাশ মাছ,
কাপড়ে জড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ।
ওরে মুখ – পোড়া ওরে বাঁদর।
গালি – ভরা মার অমনি আদর,
কতদিন আমি শুনি নারে ভাই আমার মায়ের পাছ;
যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
ঘন কালো বন – মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।
গাছের ছায়ায় বনের লতায়
মোর শিশুকাল লুকায়েছে হায়!
আজি সে – সব সরায়ে সরায়ে খুজিয়া লইব তায়,
যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গায়।
তোরে নিয়ে যাব আমাদের গাঁয়ে ঘন-পল্লব তলে
লুকায়ে থাকিস, খুজে যেন কেহ পায় না কোনই বলে।
মেঠো কোন ফুল কুড়াইতে যেয়ে,
হারাইয়া যাস পথ নাহি পেয়ে;
অলস দেহটি মাটিতে বিছায়ে ঘুমাস সন্ধ্যা হলে,
সারা গাঁও আমি খুজিয়া ফিরিব তোরি নাম বলে বলে।
নিমন্ত্রণ
– কবি জসীম উদ্দীন।
নগরকে বাঁচাতে আমাদের গ্রামের কোলেই ফিরে যেতে হবে, সেখানেই সুপ্ত রয়েছে জীবনের বীজ, সেই বীজকে নিবিড় মায়া মমতা দিয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটাতে হলে “আমাদের গ্রাম আমাদের জীবন” নামক ভেলায় উঠে পড়তে হবে সেই সব হিসেবী জীবনের কোটিপতিদের। দুহাত ভরে শুধু এতোদিন গ্রহণ করেছি জীবনের যেটুকু বিষাক্ত নির্যাস আজ তা উগরে দিতে ফিরে যাবো গ্রাম নামক গ্রহানুগুলোর উন্নয়নে হাতেহাত রেখে কাধেকাধ মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আমি তো দেখছি কতো মানুষের অব্যবহৃত সম্পদ পড়ে রয়েছে গ্রামে গ্রামে, অবহেলায়, অনাদরে সম্পদ পরিণত হচ্ছে আবর্জনায়। সোনা ফলা মাটিতে জন্ম নিচ্ছে ফলহীন বৃক্ষ আর অপ্রয়োজনীয় আগাছা, এসব বাড়তি সম্পদ নিয়ে কাড়াকাড়ি মারামারির উপলক্ষ্য তৈরি হচ্ছে প্রতিটি দিন।
এসো বন্ধু চল্লিশ পেরুনো চালশে হৃদয়পতির দল, কোটিপতি না হলেও চলবে, শুধুই যদি গ্রামে থাকে তোমার অব্যহহৃত ভিটেমাটি তো যুক্ত হও “আমাদের গ্রাম আমাদের জীবন” ট্রাষ্টের উদ্যোগের সাথে, এসো উল্টো পথে পরিবর্তনের অঙ্গীকারে আবদ্ধ স্বপ্নবাজ কিছু মানুষের সাথে হারতে যাই, জিততে নয়!
Leave a Reply