আমি একজন বিশেষ শিশুর মা, আমার ছেলের বয়স এখন পনেরো বছর। একদম প্রথম থেকে শুরু করি। আমার ছেলের তিন বছর বয়স পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করেছি, আমি খুব খুশি ছিলাম আমার ছেলে অনেক মেধাবী। কারন আমি ওকে ওর দেড় বছর বয়সে যেসব কঠিন কঠিন ইংরেজি শব্দ শিখিয়েছিলাম ও দিব্যি ছবি দেখে সব বলে দিতে পারতো। ওর তিন বছর বয়সে একটা খিচুনি এসে আমাদের জীবনের সব গুটি ওলট-পালট করে দিলো। হঠাৎ করেই ওর বিকাশ ধীরগতির হয়ে গেলো এবং কথা বলা এগুচ্ছিলো না। আমি ওর সাড়ে তিন বছর বয়সে ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। আমার ছেলে তখন ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই ঢাকার একটা নামকরা স্কুলে চান্স পায়। কিন্তু এরপর আস্তে আস্তে সবই পিছিয়ে যেতে থাকে। একটু একটু করে ওর ব্যবহারে অস্থিরতা বাড়তে থাকে, ঘুমের সমস্যা হতে থেকে, তিন মাস পরপর ঘুমের ভিতর মৃদু খিচুনি আসে। খিচুনি বিশেষজ্ঞ এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্র এর মাধ্যমে অবশেষে আইডেন্টিফাই হয় আমার ছেলে বিশেষ শিশু।
আমার সংগ্রাম শুরু তখন থেকে। আমি একজন ব্যাংকার, এরমধ্যেই আমার স্বামীর ঢাকার বাইরে একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগদান করে। শুরু হয় আমার একার পথ চলা, সংগ্রাম শুরু হয় আমার ছেলেকে নিয়ে। অফিস থেকে ফিরে ছেলের সাথে প্রচুর কথা বলতাম, পড়াতে বসতাম। সিআরপিতে থেরাপি দিতে নিয়ে যেতাম, আবার বাসায় এসে নিজে বিভিন্ন থেরাপি দিতাম। যেহেতু আমার ছেলের খিচুনি হত রাতে ঘুমের মধ্যে তাই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থেকে পাহারা দিতাম খিচুনি আসে কিনা। সাপ্তাহিক ছুটির একদিন ওকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে বের হতাম। বাইরে ঘুরতে গিয়ে অনেকদিন অনেক অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হতো কারন আমাদের দেশের মানুষেরা এখনো বিশেষ শিশু কি সেটা বুঝে না, বাসায় এসে অনেক কাদতাম। আমার ছেলেকে বুঝাতাম, সঠিক আচরন শেখাতাম, ও ধীরেধীরে বুঝতে শেখে। ওই সময় ছেলের সাথে যারা খারাপ আচরণ করত তাদের উপর তখন রাগ থাকলেও এখন আর নেই। কারন আমার ছেলে ঐ খারাপ ব্যবহারগুলো না পেলে আজ Good Manners গুলো শিখতো না। এখন আমার ছেলে ছোট বাচ্চা কাউকে খেলতে দেখলে তাকে সহযোগিতা করে, খেলনা পড়ে গেলে উঠিয়ে তার হাতে দেয়। কাউকে আর ধাক্কা দেয় না বা আঘাত করে না খেলতে খেলতে।
আমি আমার সব সময় এবং শক্তি ওর পিছনে ব্যয় করেছি, করছি। এই সময়গুলো অনেক কঠিন ছিলো, অনেক সময় হেরে গিয়ে কান্নায় ভেংগে পড়েছি জায়নামাজে বসে। কখনো কখনো আশাহত হয়ে পড়েছি, সব মনোবল হারিয়ে ফেলেছি। সেই কঠিন সময় আমার স্বামী, ভাইবোন এবং প্রিয় কিছু মানুষ আমাকে আবার ঘুরে দাড়াতে সহযোগিতা করেছে। তাদের সাহায্য ছাড়া আমি হয়তো ওখানেই থেমে যেতাম।
আমার ছেলেকে আমি সবরকমভাবেই বিভিন্ন জিনিস শিখিয়েছি, কখনো আদর করে কখনো শাসন করে। কখনো কখনো ওর সাথে ভাইবোনের মত আচরন করে শেখাই। এখন ও বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলতে পারে, ঝগড়া করতে পারে, নিজের জিনিস গুছিয়ে রাখতে পারে, নিজের পছন অপছন্দ প্রকাশ করতে পারে। এখনো কিছু Behavior সমস্যা আছে, Learning Disability আছে, শিখছে ধীরেধীরে, অনেক শ্রম দিতে হয় এর জন্য। আমি যেকোনো কাজে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করার চেষ্টা করি, সব সময় সব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না তবে আমার সম্পূর্ণ চেষ্টা থাকে। কারন আমি বিশ্বাস করি যেকোন কাজে সম্পূর্ণ আত্মনিয়োগ করলে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করলে একটা ইতিবাচক ফলাফল আসতে বাধ্য যত ধীরে ধীরে আসুক না কেন। আমি চেষ্টা করি সব সময় ভালো কাজ করতে, মানুষের উপকার করতে, যেন আল্লাহ আমার কোন কাজে খুশি হয়ে আমার এই কঠিন দিনগুলো সহজ করে দেন।
এখন আমার ছেলে স্বপ্ন দেখে জীবনে কিছু হওয়ার, স্বপ্নটার নাম বল্লাম না, পূরণ হলে বলব। আমিও দোয়া করি ওর স্বপ্ন পূরণের জন্য। কিন্তু এখনো অনেক কঠিন পথ সামনে বাকি, পরিশ্রম আমাদের করে যেতেই হবে। গত তিন বছর আমার স্বামী ঢাকায় এসে আমাকে সহযোগিতা করছে, আমরা আশা ছাড়ব না ইনশাআল্লাহ।
এতো কষ্টের মাঝেও আমার সব কষ্ট দুর হয়ে যায় তখন যখন দেখি মাঝে মাঝে অনেক ইমোশনাল হয়ে আমার ছেলে দু-হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া করে- “হে আল্লাহ আমার মা কে বেহেশতে নিন, আমার বাবাকে বেহেশতে নিন”। এরচেয়ে বড় পাওয়া কি হতে পারে? ভালোবাসা সকল বিশেষ শিশু এবং তাদের মা-বাবার জন্য।
*লেখাটি পেন্সিল নামক ফেসবুক পেজে ১৪ আগষ্ট ২০২০ তারিখে প্রকাশিত হয়।
ফারহানা রহমান, ব্যাংকার, ঢাকা থেকে।
Leave a Reply