প্রথমবারের মতো মানুষের শ্বাসনালীতে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা মাইক্রোপ্লাস্টিক শনাক্ত করেছেন অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. সাইদুল ইসলাম ও তার সহযোগী গবেষক দল।
১৩ জুন, আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স পাবলিকেশনের Physics of Fluids জার্নালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে, অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনির মেকানিক্যাল অ্যান্ড মেকাট্রনিক্সের প্রভাষক ড. সাইদুল ইসলাম, মানুষের শ্বাসনালীতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবহন এবং জমা বিশ্লেষণ করে একটি কম্পিউটেশনাল ফ্লুইড ডাইনামিক মডেল তৈরি করেছেন।
গবেষণাটি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। ফিজিক্স অর্গ, এআইপি নিউজ, মাইক্রোসফট নিউজ এবং সাইন্স ডেইলির মতো প্রায় দুই শতাধিক আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ জার্নালটি নিউজ, প্রবন্ধ হিসেবে কাভার করেছে।
বিশ্বখ্যাত অল্টমেট্রিক প্রতিবেদন অনুসারে গবেষণাটি গুণগত মান এবং অনলাইনে শীর্ষে অবস্থান করছে। অল্টমেট্রিক বলছে, তাদের সংরক্ষণে থাকা ২.৫ কোটি গবেষণার মধ্যে এটি টপ। এ গবেষণাটির মাধ্যমে বিশ্বের মানুষের কাছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ভয়াবহতার খবর পৌঁছে গেছে।
গবেষণাটি বলছে, মানুষ প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৬.২ বিট সমপরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো আমাদের দেহে আসে মনুষ্য সৃষ্ট প্লাস্টিক পণ্যগুলোর ক্ষুদ্র ধ্বংসাবশেষ থেকে। এছাড়া মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো কতটা গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রা প্লাস্টিকগুলো কীভাবে শ্বাসযন্ত্রে কী পরিমাণ ক্ষতি করে তা এই গবেষণাটির মূল বিষয়।
বিশ্বব্যাপী মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপাদন বাড়ছে এবং বাতাসে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. সাইদুল ইসলাম বলেছেন, প্রথমবারের মতো ২০২২ সালে, গবেষণায় মানুষের শ্বাসনালীর গভীরে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা আমাদের শ্বাসনালীর স্বাস্থ্যঝুঁকি গুরুতরভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। গবেষক দলটি বিভিন্ন আকৃতির এবং আকারের (১.৬, ২.৫৬ এবং ৫.৫৬ মাইক্রন) মাইক্রোপ্লাস্টিক ধীর এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে কীভাবে ফুসফুসে পরিবহন করে তার গতিবিধি লক্ষ্য করেছেন।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা নিঃশ্বাসের ফলে কী ঘটে? এ প্রশ্নের জবাবে ড. ইসলাম বলেন, বড় আকৃতির মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো অধিকাংশ আমাদের নাকের ভেতরে যে চুল আছে সেখানে আটকে যায়। ছোট মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো আকার এবং আকৃতির ওপর ভিত্তি করে ফুসফুসের নিচের অংশে প্রবেশ করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো ফুসফুসের ভেতরে বাতাসের গতি ও নানা শারীরবৃত্তিও কারণে ফুসফুসের আঠালো মিউকাস অংশে জমা হয়।
কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা প্রশ্বাসের মাধ্যমে বের হয়ে আসতে পারে। ফুসফুসের আঠালো মিউকাস অংশে জমা হওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বিষাক্ত হতে পারে এবং অবশেষে ক্যানসারসহও নানান ধরনের ফুসফুসের রোগ ঘটাতে পারে। অতি ক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলো ফুসফুসের আল্ভেওলি থেকে অন্যান্য লেয়ার অতিক্রম করে শরীরের রক্তের মধ্যে ও প্রবেশ করতে পারে।
ড. ইসলাম আরও বলেন, শ্বাসনালীর জটিল অনাটোমিকাল (শারীরবৃত্তীয়) আকৃতি এবং গলার অংশের জটিল বাতাস প্রবাহের কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো তাদের পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং আমাদের শ্বাসনাল অঞ্চলে জমা হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবাহের গতি, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার জড়তা এবং অসমঞ্জস্য অনাটোমিকাল আকৃতি মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলোর গতিপথ প্রভাবিত করে এবং গলার মধ্যে বা গলার পেছনের এলাকায় জমিয়ে তার ঘনত্ব বাড়ায়। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের অবস্থা এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার আমাদের শ্বাসনালীতে সামগ্রিক মাইক্রোপ্লাস্টিক জমার হারকেও প্রভাবিত করে। গবেষক দল উল্লেখ করেন, মাইক্রোপ্লাস্টিকগুলো তাদের স্থির প্রকৃতি, ফুসফুসে জমা হওয়ার ক্ষমতা এবং বন্যপ্রাণীর ক্ষতি করার এবং পরিবেশগত ভারসাম্যকে ব্যাহত করার সম্ভাবনার কারণে একটি গুরুতর হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
এই গবেষণায় আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি এবং সম্ভাব্য স্বাস্থ্যগত প্রভাব সম্পর্কে বৃহত্তর সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে বলেছেন গবেষক দল। ভবিষ্যতে, এ গবেষক দল একটি বড় আকারে আমাদের পুরো শ্বাসনালীর মডেলে মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবহন বিশ্লেষণ করার পরিকল্পনা করেছেন যা পৃথিবীতে বাতাসের আর্দ্রতা এবং তাপমাত্রার মতো পরিবেশগত বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে।
ড. সাইদুল ইসলাম সাতক্ষীরার, কালীগঞ্জ থানার নলতা ইউনিয়নের সেহারা গ্রামের সন্তান। তিনি বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত ঘেঁষা খানজিয়া হাই-স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি, নলতা আহছানিয়া মিশন রেসিডেন্সিয়াল কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ডিসিপ্লিন (ব্যাচ-২০০৫) থেকে স্নাতক ও অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্সের ওপর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। পরে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি থেকে ইউনিভার্সিতে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন এবং ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনি থেকে পোস্টডক করে একই ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন সাইদুল। https://profiles.uts.edu.au/MohammadSaidul.Islam
গবেষক দলের অন্য বিজ্ঞানীরা হলেন- ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির মো. মিজানুর রহমান, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির এমিলি সাউরেট এবং ইয়ান টং গু, ইরানের উর্মিয়া ইউনিভার্সিটির আকবর আরসালানলু, ইসলামিক আজাদ ইউনিভার্সিটির হামিদরেজা মুর্তজাভী বেনী এবং ‘দ্য ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’র আরিফুল ইসলাম।
সূত্রঃ জাগো নিউজ ২৪ ডটকম অনলাইন পত্রিকা।
Leave a Reply