পর্ব-১
এক সময় ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালের দিকে আমাদের খুলনা-যশোর অঞ্চল হতে ঢাকা ভ্রমণের জন্য দ্রুতগামী চেয়ার কোচের প্রচলন হলো। তার আগে বিআরটিসি বাসে সরাসরি অথবা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এক জেলা থেকে আর এক জেলায় গিয়ে বাস পরিবর্তন করে ঢাকা যেতে হতো। ছেলেবেলায় আব্বার সাথে একবার ঢাকায় যাবার জন্য কুষ্টিয়া থেকে লোকাল ট্রেনে করে দৌলদিয়া ঘাট পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলাম। তবে মানুষ বাসে করেই ঢাকা ভ্রমণ করতে অভ্যস্ত ছিলো, তখন একটু আরামে ভ্রমণের জন্য চালু হয়েছিলো দিগন্ত, সৌখিন, ফাইভ স্টার নামের কিছু চেয়ার কোচ। আমরা বলতাম পরিবহণ, সেসব পরিবহণে প্রতি সারিতে ৫ টি আসন ছিলো, সবাই চেষ্টা করতো বাম পাশের দুই আসনের সিটের টিকেট নেবার, না পেলে বাধ্য হয়ে তিন সিটের ডান পাশের সিট নিতে হতো এবং চাপাচাপি করে বসে ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে বেশ বেগ পেতে হতো! একটু সাইজে মোটা কেউ থাকলে কোনার সিটে বসা পাবলিকের মাঝেমাঝেই সিট থেকে পড়ে যাবার সম্ভাবনা তৈরি হতো।
বেশিরভাগ পরিবহণ ছিলো লঞ্চ পারাপার, ফেরী পারাপারের ভাড়া বেশি হওয়াতে সাধারণ মানুষ লঞ্চ পারাপার পরিবহণেই বেশি ভ্রমণ করতো। অর্থাৎ দৌলদিয়া পর্যন্ত পৌঁছে লঞ্চ ঘাটের কাছে নামিয়ে দেয়া হয় যাত্রীদের এরপর ওই পরিবহনের তত্বাবধানে ভাড়া করা লঞ্চে করে আরিচা ঘাটে নেমে একই পরিবহনের আরেকটি বাসে করে ঢাকা পর্যন্ত ভ্রমণ করতে হয়। ফেরী পারাপারে সময় বেশি লাগার কারনে যারা দ্রুত ঢাকায় যেতে ইচ্ছুক এবং সাথে তেমন কোন ভারী লাগেজ না থাকলে লঞ্চ পারাপারে ঢাকা ভ্রমণেই বেশি সুবিধা। তবে কথা আছে, সন্ধ্যা সাতটা বা আটটার পর লঞ্চ পারাপার বন্ধ হয়ে যায় আবার ভরা বর্ষা মৌসুমে লঞ্চ পার হতে বুকে সাহস থাকা লাগতো। কারন ১৯৮০-৯০ সালের পদ্মা নদীর ভরা মৌসুমে এক পার থেকে অন্য পার দেখা যেতো না। নদীতে থাকতো বিশাল ঢেউ এবং তীব্র স্রোত, সবাই মোটামুটি দোয়া দরূদ পড়ে আল্লাহ রাসুলের নাম নিতে নিতে লঞ্চ পার হতো।
এই লঞ্চে উঠে আবার কিছু খাদ্য রসিক ব্যাগ-বাক্স গুছিয়ে ছুটে যায় লঞ্চের নীচতলায়, সেখানে গিয়ে ইঞ্জিন রুমের পাশে সেট করা টেবিল বেঞ্চি দখল করে। জায়গা না পেলে কেউ কেউ হাতে হাতে প্লেট নিয়েই অপেক্ষা করে চিরচেনা এক খাবারের স্বাদ নেবার জন্য। খুবই সাদামাটা ইলিশ মাছ কড়া করে ভাঁজি, শুকনা মরিচ পোড়া আর হয়তো ঘন করে রান্না মশুড়ির ডাল। আরেব্বা, এই লঞ্চের ইলিশ ভাঁজি নাকি বাংলাদেশের সেরা, এই টেষ্ট নাকি আর কোথাও পাওয়া যায় না! বিশেষ করে মাওয়া ঘাটের লঞ্চের রান্না নাকি বেস্ট অফ দ্য বেস্ট? যদিও লঞ্চের পরিবেশ, প্লেটের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অতটা ভালো নয় তবুও আমি সেই স্বাদ নিতে পিছপা হইনি, আসলেই কি যেনো একটা আলাদা স্বাদ আছে বৈকি? খিদে পেট হলে তো কথাই নেই এক কথায় অমৃত অমৃত! এই খাদ্য প্রেম ছাড়াও লঞ্চে উঠে একই বাসের যাত্রীদের সাথে ভালোভাবে দেখা সাক্ষাৎ পরিচিত হবার সুযোগ তৈরি হতো!
এই পারাপারের লঞ্চগুলো আকারে ছোট, খুবই দূর্ঘটনাপ্রবণ, বড় বড় ঢেউয়ের কবলে পড়ে বেসামাল হয়ে পড়ে। আর প্রায়ই ধারনক্ষমতার তুলনায় অধিক যাত্রী বহন করে থাকে, মাঝে মাঝেই বড় বড় দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, আল্লাহ কখনো কখনো নিজ রহমতে বাঁচিয়ে দেন আর কখনোবা ঘটে যায় ভয়াবহ লঞ্চ ডুবির মতো করুন ট্রাজেডী! কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দূর্ভাগ্য যে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে যুগের পর যুগ ঝুকি নিয়েই এই রকম ঝুঁকিযুক্ত জলযানে ভ্রমণ করে এসেছে। কারণ আমাদের আর কোন উপায় ছিলো না, এত দীর্ঘদিন যে এমন ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে মানুষ কোন সরকারই কিন্তু ভ্রমণ উপযুক্ত নিরাপদ লঞ্চের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। দূর্ঘটনায় পতিত লঞ্চ ও মানুষ উদ্ধারের জন্য এসব ঘাটে থাকে না কোন উদ্ধারকারী কতৃপক্ষ বা জাহাজ! মানুষ মরলে মরুক, লাশ প্রতি ১০ হাজার টাকা দিলেই তো কেস খালাস, এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি কোনদিন!
পল্লব খন্দকার, ২৬ জুন ২০২৩।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply