ছোটবেলায় কোরবানীর মাহাত্ম্য, কেন কোরবানী দিচ্ছি, কে দিচ্ছে, কার নামে কোরবানী দেয়া যাবে এগুলো নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যাথাই ছিল না।
তখন কোরবানী ঈদ মানেই হচ্ছে মাংস খাওয়ার ধুম।
মফস্বলে অনেকে এটাকে বকরীর ঈদও বলে। কিন্তু আমাদের কাছে তখন ঈদ মানেই হচ্ছে নতুন জামা ও জুতো। রোজার ঈদে যেখানে ৩/৪ টা জামা জুটে যেত। সেখানে কোরবানী ঈদে শুধু আম্মা তাঁর রোজগারের টাকা দিয়েই আমাদের চার ভাইবোনকে একটা করে জামা কিনে দিতেন।
একবার এক ঈদে ‘আমাকে এবার হিল জুতা কিনে দিবা প্লিজ প্লিজ’ সারাদিন একই জপ জপতে থাকলাম আব্বার পিছে পিছে। আব্বা বিরক্ত হওয়ার ভাব নিয়ে মার্কেটে নিয়ে গিয়ে আমাকে হিল জুতা কিনে দিলেন। আমি তো মহা মহা খুশি। জুতার বাক্সটা নিয়ে আম্মার তুলে রাখা বড় পাতিলটার মধ্যে লুকিয়ে রাখলাম।
ওমা!
ঈদের আগের রাতে আম্মা দেখি ঠিক ঐ পাতিলটাই বের করে এনেছে। মাংস রান্না করার জন্য বড় পাতিলগুলো তোলা থাকতো সযতনে।
ধুর! দৌড়ে গিয়ে জুতার বাক্সটা এনে ‘কোথায় রাখবো’ করতে করতে জায়গা না পেয়ে একবার নিজের বালিশের নিচে, আরেকবার খাটের নিচে, আরেকবার আলনার পিছনে লুকিয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।
পরদিন নতুন জামা, নতুন হাইহিল জুতা, চুলে ক্লিপ, হাতে চুড়ি, নখপালিশ, পায়ে নূপুর পরে সেমাই আর পোলাও মাংস খাওয়ার ধুম পড়ে গেল। আর সেইদিন আমাদের সাজ-গোজেরও কোনো বাঁধাধরা ‘সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ’ থাকতো না। তাই লিপস্টিক ঠোঁটে লাগিয়ে আর কথা বলতে ইচ্ছা করতো না। কেমন করে যেন ঠোঁটটা একটু ফুলিয়ে রাখতাম।
সেই ঠোঁট ফোলানো লিপস্টিক নিতে এখনো ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে লাল টকটকে নখপালিশ আর পায়ে নূপুর পরে, ফ্রক পরে, দুই বেনী দুলিয়ে দুলিয়ে পাড়া বেড়াতে।
শুধু বিরক্তিকর বর্তমান সময়টা আমাদেরকে একটা শক্ত দড়ি দিয়ে আমাদের ইচ্ছার দু’টো হাতই পিছন দিক থেকে বেঁধে রেখেছে। তাই এসবের কিছুই এখন আর করা হয়ে ওঠে না।
ঈদের দিন কোন বাসায় যাওয়ার কোন নির্ধারিত সময় ছিল না। ইচ্ছামত ঘোরাঘুরি। নিজেদের বেড়ানোর গন্ডি শেষ হলে বিকেল বা সন্ধ্যার দিকে আম্মার সাথে বেড়াতে যেতাম দূরের কোন আত্মীয় বা পারিবারিক বন্ধুর বাসায়। সবাই গিয়ে তাদের গোছানো বসার ঘরে বসতাম। ভেতর ঘর থেকে পোলাও, মাংস, কোর্মা আর সেমাইয়ের বাটি আসতো। সাথে একটা হাত ধোয়ার বাটিও। আমরা জগের পানি দিয়ে হাত ধুয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। একবার আম্মার দিকে তাকাতাম, একবার খাবারের দিকে তাকাতাম। কারন, আম্মা চোখের ইশারায় ওগুলো ধরতে না বলা পর্যন্ত আমাদের খাবার নেয়া বারন ছিল। ইশারা পাওয়া মাত্রই ঝাঁপিয়ে পড়তাম খাবারের উপরে।
এখন আর বাচ্চাদেরকে ঈদের জামা-জুতার দিকে নেশা দেখি না। আগ্রহ দেখি না… সকালে বা বিকালে কোথায় ঘুরতে যাবে অথবা কাকে কাকে সালাম করলে বেশি টাকা পাওয়া যাবে। কিংবা বায়না ধরে না যে, ” আম্মু আমি সেমাই খাবো না, আমার জন্য পায়েশ বা জর্দা রান্না করো।”
আর পোলাও-মাংস তো ওদের এখন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে। তাই ওগুলোর ঘ্রাণও ওদেরকে ঈদের আনন্দকে মনে করিয়ে দেয় না। তবুও কি জানি কি ভেবে সবকিছুই টুকটাক করে রান্না করি। হয়তো ৩০ বছর পরে ওরাও আমার মত করে কিছু কিছু জিনিস মনের মধ্যে লালন করে কিছু একটা লেখার চেষ্টা করবে।
শাইনি শিফা, আবৃত্তিকার, বাংলাদেশ বেতার।
২৮ জুন ২০২৩।
Leave a Reply