সাপ্তাহিক ব্লগ – খুলনার কথকতা থেকে সংগৃহীতঃ মূল লেখা সুস্মিত সাইফ আহমেদ
সতত হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা, ভাবি এ বিরলে…
মাধ্যমিক শ্রেণিতে আমরা অনেকেই পড়েছি কবিতাটা, তাই সকলেই জানি বাংলা সাহিত্যে অমৃত্তিক্ষার ছন্দের জনক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই কবিতাটি লিখেছেন। কপোতাক্ষ নদের পাড়েই ১৯৮ বছর আগে জানুয়ারী মাসের এক হাড়কাঁপানো মাঘের শীতে জন্মেছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। ভাবতেই অবাক লাগে, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক নাট্যকার, আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহাকবি, বাংলা ভাষায় চতুর্দশপদী কবিতা বা সনেট বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবক্তা মাইকেল আসলে যশোর–খুলনার কৃতি ‘ছোয়াল‘।
বৃহত্তর খুলনার যশোর জেলার (তৎকালীন যশোর জেলা সদরে) কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়িতে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতা সদর দেওয়ানী আদালতের ডাকসাইটে উকিল এবং ভূস্বামী। মাতা জাহ্নবী দেবী ছিলেন পাইকগাছার কাটিপাড়ায় এক সম্ভ্রান্ত বংশের মেয়ে। কারো কারো মতে, মামাবাড়িতেই নাকি মাইকেলের জন্ম, যদিও অধিকাংশ সূত্রমতে সাগরদাঁড়িই কবির জন্মস্থান।
জমিদারি থাকলেও দত্ত পরিবার ছিল উদারপন্থী। তাইতো শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়ার মধ্যে দিয়েই মধুসূদনের শিক্ষাজীবন শুরু। তবে ছোট থেকেই মাইকেলের ছিল সাহেবী জীবনের অভিলাষ। পাড়াগাঁয়ে আর কতদিন–ই বা থাকতো! তাই ১৩ বছর বয়সেই বাবার সাথে কলকাতায় চলে আসেন তিনি। কিছুদিন পর ভর্তি হন কলকাতার হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়)। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি, কিন্তু কলেজের থেকে খিদিরপুরে তাঁদের বিরাট অট্টালিকায় বন্ধু–বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। কলেজে পড়াকালীন সময়ে ইংরেজি ভাষার সাহিত্যিক এবং বিলেত যাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরী হয় তাঁর। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। ফলশ্রুতিতে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষিত হন। এমনকি বিলেত থেকে ফিরে ১৮৬২ সাল নাগাদ কবি যখন সপরিবারে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন তখন ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে জ্ঞাতিরা তাঁকে বাড়িতেও উঠতে দেয় নি। তিনি একটা কাঠবাদাম গাছের তলায় তাঁবু খাটিয়ে ১৪ দিন অবস্থান করে বিফল মনে কলকাতা ফিরে যান। এমন ঘটনার সম্মুখীনই হয়েছিলেন মামাবাড়ি কাটিপাড়া ভ্রমণকালে। পরবর্তী জীবনে মাদ্রাজ, লন্ডন, ভার্সাই শহরে ভাগ্যান্বেষণে ঘোরা। চরম অর্থ সংকটে বিদেশ–বিভূইয়ের দিনগুলো কেটেছিল তাঁর। ফিরে এলেন তিনি কলকাতায়। এখান থেকেই তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার নবজাগরণ।
তাঁর অমর সৃষ্টি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য ১৮৬১ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। মেঘনাদবধ কাব্যের ষষ্ঠ সর্গের অংশ বিশেষ যা “মেঘনাদ ও বিভীষণ” নামে পরিচিত তা নিম্নরূপ। এ থেকেই অমিত্রাক্ষর ছন্দের স্বরূপ বোঝা যায়-
“এতক্ষণে” –অরিন্দম কহিলা বিষাদে
“জানিনু কেমনে আসি লক্ষণ পশিল
রক্ষঃপুরে! হায়, তাত, উচিত কি তব
একাজ, নিকষা সতী তোমার জননী,
সহোদর রক্ষশ্রেষ্ঠ? –শূলী-শম্ভূনিভ
কুম্ভকর্ণ? ভ্রাতৃপুত্র বাসব বিজয়ী?
নিজগৃহপথ, তাত, দেখাও তস্করে?
চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে?
কিন্তু নাহি গঞ্জি তোমা, গুরুজন তুমি
পিতৃতুল্য। ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে,
পাঠাইব রামানুজে শমন-ভবনে,
লঙ্কার কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে”
মাইকেল মধুসূদন দত্তের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী (নাটক); মেঘনাদবধ কাব্য (মহাকাব্য); বীরাঙ্গনা কাব্য, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী (কাব্যগ্রন্থ); দ্য ইন্ডিগো প্লান্টিং মিরর (নীল দর্পণ নাটকের অনুবাদ), ক্যাপটিভ লেডি, রিজিয়া (ইংরেজি সাহিত্যকর্ম), বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, একেই কি বলে সভ্যতা (প্রহসন) উল্লেখযোগ্য।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (২৫ জানুয়ারি ১৮২৪ – ২৯ জুন ১৮৭৩) মাত্র ৪৯ বছর বয়সে চরম অর্থ সংকটের মধ্য দিয়েই চিরবিদায় নেন। ১৯৬৫ সালের ২৬ অক্টোবর তদানীন্তন সরকার মাইকেল মধুসূদন দত্তের পৈত্রিক বাড়িটি পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৬৮ সালে বাড়িটি সংস্কার শুরু হয় এবং মধুসূদন পরিবারের ব্যবহার্য কিছু আসবাবপত্র ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে এ বাড়িতেই প্রতিষ্ঠিত হয় ‘মধুসূদন জাদুঘর‘ এবং লাইব্রেরি। ১৯৯৪ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় সাগরদাঁড়ি কমপ্লেক্সে ‘মধুমেলা‘-র আয়োজন শুরু হয় যা আজো চলমান। মহাকবি মাইকেলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে খুলনা–রাজশাহীগামী দুটি আন্তঃনগর ট্রেনের নাম রাখা হয়েছে কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস এবং সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস।
মধু কবির জীবনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র এবং রচিত হয়েছে যাত্রা পালা যা আজো মানুষকে মুগ্ধ করে রাখে।
বাংলা সাহিত্যের অমর প্রতিভা এই মহান মানুষটিকে আমরা সবসময় শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে যাবো।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন/যশোর জেলা
সেই সময় (সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
উইকিপিডিয়া
#খুলনার_কথকতা
#খুলনা_ইন্সটিটিউট
সংকলনেঃ দৈনিক আলোকবর্তিকা ডেস্ক।
Leave a Reply