নিরাপদ দুধ চাই। আমাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার জন্য, আমাদের শিশুদের দৈহিক বৃদ্ধি এবং মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য এবং গর্ভবতী মা ও বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য আমরা নিরাপদ দুধ চাই। কিন্তু নিরাপদ দুধ আমরা খুব সহজেই পাই না। দুধ পান করার সময় মনে হয় ‘দুধই পান করছি তো’? দুধ নিয়ে এ আশঙ্কা নিয়েই আমরা দুধ পান করছি। এটাও ঠিক, দুধের ঘ্রান যুক্ত সাদা তরল মানেই তো আর দুধ না, দুধ হলেও তাতে অদৃশ্য কত কিছুই না থাকতে পারে?
গ্রামে-গঞ্জে, মফঃস্বল শহরে সাধারণত গাভীর দুধ পাই সরাসরি গাভী পালনকারীর কাছ থেকে, হাট-বাজারে অথবা গোয়ালাদের কাছ থেকে। কারো কারো ভরসা কোম্পানীর প্যাকেটজাত দুধের উপরও। দুধ উৎপাদনকারী অর্থাৎ গাভী পালনকারী এবং দুধ সরবরাহকারী উভয়ই নানানভাবে, সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে, সরবরাহ চেইনের বিভিন্ন ধাপে তাদের নানান রকম কর্মকাণ্ড দ্বারা উৎপাদিত গাভীর দুধকে অনিরাপদ করে ফেলে। গাভী লালন-পালন, গো খাদ্য, চিকিৎসা, গোয়াল ঘর, দুধ দোহনশেড ব্যবস্থাপনা, দুধ দোহন, সংরক্ষন এবং বাজারজাতকরন ইত্যাদি নানান পর্যায়েই গাভীর দুধ অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। যেখানে যে পর্যায় যার দ্বারাই হোক না কেন অনিরাপদ দুধ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ডেইরি খামারীদের বেশীরভাগই নারী। তাঁরা গাভীর দুধ বিক্রি করে গাভীর খাবার কেনেন। বাড়তি অর্থ সংসার খরচ, সন্তানের পড়াশুনার খরচ এবং নিজেদের চিকিৎসা কাজেও ব্যয় করেন। গাভীর চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসম্মত গোয়ালঘর এবং দুধ দোহনের শেড উন্নয়নে খুব কমই ব্যয় করে পারেন। ফলে বেশীরভাগ ছোট এবং মাঝারি ডেইরি খামারীর গোয়াল ঘরই অস্বাস্থ্যকর এবং অপরিচ্ছন্ন। আর এই অস্বাস্থ্যকর এবং অপরিচ্ছন্ন গোয়াল ঘর এবং দুধ দোহনের শেডিংই হচ্ছে দুধ অনিরাপদ হওয়ার একটা বড় স্থান। গোয়াল ঘরের এবড়ো-থেবড়ো মেঝে, ছড়ানো-ছিটানো গোবর-মূত্র-আবর্জনা, ভেজা- স্যাতস্যেতে বেডিং এর স্থান, ড্রেন না থাকা, আলো-বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না থাকা এবং শেডের পাশেই খোলা জায়গায় কাঁচা গোবর স্তুপ করে রাখা এসবের কারনেই দোহন এর পর গাভীর দুধ অনেক সময় অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে।
নিরাপদ দুধের জন্য গাভী দোহনের প্রক্রিয়াটিও স্বাস্থ্যকর হওয়া খুবই প্রয়োজন। গাভী দোহনের প্রক্রিয়াটির মধ্যে রয়েছে দুধ দোহনের আগে গাভীকে দানাদার খাবার খাওয়ানো, ওলান ভালো করে ধোয়া, দোহনের আগে ওলানের বাট জীবানুনাশক (আয়োডিন সল্যুশন) দিয়ে টিট ডিপিং করে নেয়া, এবং পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বাট শুকিয়ে নেয়া, দুধ দোহনের তৈজসপত্র পরিষ্কার এবং জীবানুমুক্ত করে নেয়া, তাহলেই দোহনকৃত দুধে আর জীবাণু মিশতে পারবে না। আবার ছোঁয়াচে রোগ যেমন- হাঁচি, কাশি, কফিং, ডায়রিয়া, বমি, চামড়ায় খোচ-পাচড়া আক্রান্ত লোক দিয়ে গাভী দোহন না করিয়ে সুস্থ লোক দিয়ে দোহন করানো উচিৎ। তাহলেও দোহনকারীর শরীর থেকে জীবাণু দুধে ছড়াবে না। তবে যিনি দোহন করবেন তিনি সুস্থ হলেও তাকে প্রটিটি গাভী দোহনের আগে অবশ্যই পরিষ্কার বিশুদ্ধ পানিতে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে। কিন্তু গ্রামে-গঞ্জে ক্ষুদ্র ও মাঝারি গাভী খামারীদের বেশীরভাগই তাদের গাভীর দুধ দোহন করান গোয়ালা দিয়ে। একজন গোয়ালা কোন রকম স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই গ্রামের এক প্রান্ত থেকে শুরু করে অন্য প্রান্তের অনেকগুলো গাভীর দুধ একের পর এক দোহন করে দুধ সংগ্রহ করেন। এ প্রক্রিয়ায় নানান ভাবে দোহন করা দুধ খুব সহজেই অনিরাপদ হয়ে যেতে পারে। দুধ অনিরাপদ হওয়া ছাড়াও মেস্টাইটিস রোগাক্রান্ত গাভী থেকে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যেতে পারে সুস্থ গাভীতেও।
গাভী পালনে এবং দুধ দোহনে স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারনে যেমন দুধ অনিরাপদ হয় তেমনি দুধে ভেজাল মেশানোর মাধ্যমেও দুধ অনিরাপদ হয়। নানান ভাবে দুধে ভেজাল মেশানো হয়ে থাকে। তারমধ্যে দুধে পানি মেশানো খুব সাধারণ যা আমরা সবাই জানি। কিন্তু আমরা জানি না সেই পানি কোন পানি। সেই পানি কি পুকুরের, নদীর, আর্সেনিক যুক্ত না আর্সেনিক মুক্ত? বেশীর ভাগই অনিরাপদ পানি। ফলে পানি মেশানো দুধে জীবাণু যোগ হতেই পারে। তাছাড়া দুধে পানি দিলে দুধ পাতলা হয়ে যায়, দুধের ঘনত্ব কমে যায়, ফ্যাটের পরিমান কমে যায়। এখন গোয়ালাতো পাতলা দুধ বিক্রি করতে পারবে না। তাই পাতলা দুধের ঘনত্ব বাড়ানোর জন্য দুধে নানান কিছু যেমন স্টার্চ, ময়দা, পাউডার দুধ, চিনি ইত্যাদি মিশিয়ে তারা দুধের ঘনত্ব বাড়িয়ে বিক্রি করে। আবার, আমরা এও দেখেছি যে, গোয়ালা যখন দুধ সংগ্রহ করে তখন তারা দুধের পাত্রে খেজুর পাতা, কলাপাতা, কচুরীপানা, লতা-পাতা ইত্যাদি দিয়ে ঢেকে রাখে যাতে দুধ ঠাণ্ডা থাকে, ভালো থাকে। কিন্তু এসব লতা-পাতায় নানান ধরনের বিষাক্ত পোকা-মাকড়, জীবানু থাকতেই পারে। আমরা জানি দুধের শেলফ লাইফ ২-৪ ঘন্টা। দুধ দোহনের পর এ সময়ের মধ্য দুধ ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নীচে সংরক্ষণ করা না হলে ব্যাকটেরিয়া মাল্টিপ্লিকাশন শুরু হয়ে দুধ নষ্ট হয়ে যায়। এখন, গোয়ালারা আসলে দুধ ঠান্ডা রাখার জন্য যে লতা-পাতা ব্যবহার করে তাতে দুধের শেলফ লাইফের পর দুধ ভালো রাখার জন্য দুধকে ৪ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার নীচে রাখা সম্ভব না। গোয়ালাদের লতা-পাতার ব্যবহার নেহায়েতই একটি লোক দেখানো কৌশল মাত্র। আসলে দুধ নষ্ট না হয়ার জন্য তারা ব্যবহার করেন নানান রকম ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভস। এসব ক্ষতিকর প্রিজারভেটিভস গুলোর মধ্য রয়েছে- হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কার্বোনেট, সোডিয়াম বাই কার্বোনেট, কস্টিক সোডা, বোরিক এসিড/বোরাক্স, ডিটারজেন্ট, ইউরিয়া, ফরমালিন ইত্যাদি। যে গুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। (চলমান)
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
সময়োপযোগী একটা আর্টিকল।
পড়ে খুবই ভালো লাগলো।
Very good informative article & Thanks Maksud bhai
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা বিষয়গুলোকে চমৎকার লেখুনির মাধ্যমে ফ্রেমিং করার জন্য মাকসুদ ভাইকে সাধুবাদ। এর সাথে জনসচেতনতা বৃদ্ধিও নি:সেন্দেহে অন্যতম একটি প্রয়াস। জীবনমুখী এ বিষয়গুলো আমাদের নিজেদেরকে রিভিউ করতে সহায়তা করে।
Thanks for the wonderful article.