পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হবার পর যারা নিয়মিত খুলনা বরিশাল যাতায়াত করেছি এবং ভাঙ্গা, ফরিদপুর হয়ে মাওয়া ঘাট পার হয়েছি তাদের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন এর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই আগের পুরোনো রাস্তা ধরে চলাচল করতাম আর দূর থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্পের কার্যক্রমের কিছু হাইলাইটস দেখতে পেতাম যেনো। কোথাও বিশাল বিশাল পাথরের ডিবি সাজিয়ে পাহাড়ের উচ্চতায় রাখা আছে, কোথাওবা হাজার হাজার শ্রমিক কর্মকর্তা মাথায় হেলমেট, গায়ে ইউনিফর্ম পরে আপনমনে কাজ করে চলেছেন। দূর থেকেই দেখতে পেতাম পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের যে অংশের কাজ সম্পন্ন হয়েছে তা যে কি পরম সৌন্দর্য আর আধুনিক নির্মান শৈলীর সমন্বয়ে গড়ে উঠছিলো তা দেখে চোখ ফেরাতে পারতাম না, উন্নয়ন দেখে চোখ ধাধিয়ে যেতো! কল্পনায় ভেসে যেতাম সত্যিই কি এই রাস্তা দিয়ে পদ্মা সেতু কোনদিন পার হতে পারবো, সে তো হবে পরম সৌভাগ্য?
পদ্মা সেতু প্রকল্প ঘিরে উন্নয়নের এই মহাযজ্ঞ দেখে আমার ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ব্যবসায়িক সফরে তাইওয়ান ভ্রমণের স্মৃতি মনে করিয়ে দিতো। চায়নার অবদানে তাইওয়ানের সড়কপথ যে উতকর্ষতা লাভ করেছে তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না! রাজধানী তাইপে থেকে ৪৫০ কিঃমিঃ রাস্তা ভ্রমণে আমাদের সময় লেগেছিলো সাড়ে তিন ঘন্টা মাত্র, মাঝখানে ছিলো প্রায় ৪০ মিনিট যাত্রা বিরতি! আমাদের গাড়ী চালক (রপ্তানীকারক/ক্লায়েন্ট) মূল শহর থেকে বের হবার পর গাড়ীর ব্রেকে আর পা রাখেননি! একই গতিতে চলেছে গাড়ি, কোন সিগন্যাল বা ক্রসিং ছাড়াই এই ৫-৬ লেনের দীর্ঘ হাইওয়ে কিভাবে নির্মিত হলো তা আমার কাছে ছিলো এক বিস্ময়! আরো অবাক করার বিষয় হলো তাইওয়ান দেশটির ৭০% এলাকা পাহাড়ী, তাই অধিকাংশ স্থানে পাহাড় কেটে অথবা পাহাড়ের পাদদেশ ঘেষে গড়ে তুলতে হয়েছে নিখুত হাইওয়ে, যেখানে একটি বারের জন্যও এতটুকু ঝাঁকি অনুভূত হয়নি! তাই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ দেখে আমার মনে হতো ফরিদপুরের ভাঙ্গা হতে শরীয়তপুরের জাজিরা পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি যেনো বাংলাদেশের কোন সড়ক না! যারা ইউরোপ-আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন তারা হয়তো তুলনা করে বলতে পারবেন কতটা উন্নত মানের সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়েছে পদ্মা সেতুর দুই পারে।
২০১৮ সালের জুলাই মাস হতে আমি কর্মজীবন ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি, চাকুরীজীবী স্ত্রী আর একমাত্র বিশেষ সন্তানকে দূরে দূরে রেখে আন্তর্জাতিক সংস্থার লোভনীয় বেতনে আর ঢাকার বাইরে চাকুরী অব্যাহত রাখা সম্ভবপর হচ্ছিলো না। যদিও ঢাকায় চাকুরীর চেয়ে মফস্বলের নির্মল বাতাস, সতেজ খাবার, ব্যস্ততাহীন জীবন ঢের ঢের পছন্দের আমার কাছে। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকায় পরিবার রেখে নিয়মিত প্রতি সপ্তাহে এবং কখনো কখনো সপ্তাহে ২-৩ বার ঢাকা-খুলনা-যশোর যাতায়াত করতে হতো। পারাপারে সুবিধামতো কখনো মাওয়া ঘাট কখনো পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে ফেরি, লঞ্চ অথবা স্পীড বোট ব্যবহার করতাম। পারাপারের একেকদিনের স্মৃতি একেকরকমের হতো, অধিকাংশক্ষেত্রে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা হলেও দুই-একদিন কাকতালীয়ভাবে কোন ঝামেলা ছাড়াই সুন্দরভাবে ভ্রমণ সম্পন্ন হতো। বর্ষাকালে আর শীতকালে ছিলো বেশী বিড়ম্বনা, চরম অনিশ্চয়তা, এমনও হয়েছে ৪-৫ ঘন্টা অপেক্ষার পর ফেরিতে উঠে ফেরি ছেড়ে দিলে নিশ্চিন্তে ঘুম দিয়ে ২ ঘন্টা পরেও দেখি অপর পারে ফেরি ভিড়তেই পারেনি! বর্ষাকালের স্রোতের তোপে ঘাটের কাছেই যেতে পারেনি এই ২ ঘন্টায়, আবার ফিরে এসেছে আগের পারেই! সে যে কি এক মানসিক নির্যাতন ছিলো আমাদের নিয়মিত পারাপারের যাত্রীদের কাছে, কতোবার অফিসের গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামে অংশ নিতে পারিনি, বসের কাছে লজ্জায় মাথা হেট হয়েছে তার কোন হিসাব নাই।
আসলে পদ্মা নদী পার হওয়া নিয়ে এতো এতো এতো বেশি ভুক্তভোগী আমরা যে এই সেতু একদিন তৈরী হবে সেরকম ভাবার সাহস পর্যন্ত আমাদের হতো না! কিভাবে হবে? বঞ্চিত এলাকা হিসেবে সুনাম আছে গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোরের। কোন সরকার সহজে মন্ত্রী দিতে চায়নি, রাস্তাঘাট ব্রীজ তৈরি করার দিকে মনোযোগ দেয়নি। সব সরকারের আমলেই অবহেলার শিকার হয়েছে দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের আপামর জনগণ! আমরা মনে করতাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির এলাকা বিধায় এই অবহেলা। অথচ রপ্তানী খাতের সোনালী আঁশ খ্যাত পাট বা সাদা সোনা খ্যাত চিংড়ি এর সরবরাহকারী হিসেবে যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চল প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু আমরা উন্নয়ন দেখতাম শুধু চট্টগ্রাম, সিলেট আর ঢাকা বিভাগে! বাগেরহাট জেলার মোংলা বন্দর তো মরেই যেতে বসেছিলো চরম বঞ্চনার শিকার হয়ে। বিশ্ব খাদ্য এর দারিদ্র্যতার সূচকে উপকূলীয় জেলাগুলোর নাম সর্বাগ্রে থাকে। বারংবার প্রাকৃতিক দূর্যোগ আর লোনা পানির আগ্রাসনে কোমর সোজা করে দাড়াতে পারে না উপকূলীয় বাসিন্দা দরিদ্র মানুষগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে সিডর, আইলা, আম্ফান ইত্যাদি প্রাকৃতিক দানব সমূহ লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে মানুষের বেঁচে থাকার আশা। টেকসই বাঁধের অভাবে লোনাপানির জলাবদ্ধতা আর জলবায়ু পরিবর্তনের ধারাবাহিক নির্মমতায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার স্বপ্ন সমূহ।
তাই পদ্মা সেতু প্রকল্প আমাদের অভাগা অঞ্চলের মানুষের জন্য শুধুই একটি সেতু নয়, এ যেনো এক জিয়নকাঠি যার ছোঁয়ায় জীবিত হয়ে উঠবে রূপকথার রাজ্যের মৃত রাজকুমারী! এজন্যই পদ্মা সেতুর জন্য আমাদের অপেক্ষা ছিলো বড় কষ্টের, আমাদের চাওয়া ছিলো বড্ড বেদনায় সংক্রমিত! আহা, সত্যি ব্রীজ পার হয়ে তিন ঘন্টায় যশোর, খুলনায় পৌঁছে যাবো আমরা? ভোরে খুলনা থেকে রওনা হয়ে ঢাকায় পৌঁছে অফিসের কাজ সেরে ফিরে আসতে পারবো নির্ঝঞ্জাট শহর খুলনায়? তথাকথিত ভিআইপিদের দৌরাত্ম্যে ফেরি পার হতে গিয়ে এম্বুলেন্স এ বসে হবে নাতো মৃত্যু? সকালে আহরিত মাছ কিম্বা সবজী তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাবে ঢাকা শহরের পাইকারি বাজারে? কৃষক উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে? বৃহৎ বৃহৎ শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে? খুলনার খালিশপুর কি আবার শিল্পাঞ্চল হিসেবে জেগে উঠবে? উপকূলীয় নদীগুলোর ভেড়ী বাঁধগুলো কি টেকসই হিসেবে নির্মাণ করা হবে? সুন্দরবন কি বিশ্ব ঐতিহ্যের তকমা ফিরে পাবে? মোংলা বন্দর কি দেশের ব্যস্ততম বন্দর হিসেবে পরিগনিত হতে পারবে? খুলনায় কি আন্তর্জাতিক মানের ফাইভ স্টার হোটেল তৈরি হবে? এমন হাজারো প্রশ্ন আমাদের বঞ্চিত হৃদয়ে প্রতিধ্বনি তুলে চলেছিলো ২৫ জুন ২০২২ তারিখে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগমূহুর্ত পর্যন্ত প্রতিনিয়ত!
পল্লব খন্দকার, ০৭ জুলাই ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
খুব খুব খুব ভালো লাগলো, বলতে গেলে একদমে পড়ে ফেললাম। পড়ছি আর মনের ক্যানভাসে ভাসছিল যাতায়াতেের সেই কষ্ট মাখা দিন গুলো।