আমাদের গাভীর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, কখনো তা একজন ভেটেরিনিয়ানের পরামর্শ মতো কখনোবা খামারি নিজের জ্ঞান অনুযায়ী গাভীর বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন। দুধ অনিরাপদ হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারন হলো রোগাক্রান্ত গাভীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত এন্টিবায়োটিক। যেখানে স্বল্পমাত্রায় মেস্টাইটিস (Mastitis) আক্রান্ত গাভীর চিকিৎসা হলুদ বাটা, চুন আর এল্যোভেরা দিয়েই করে ফেলা যায় সেখানে দ্রুত ফলাফল পেতে অনেকেই এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন! গাভীর চিকিৎসায় যত্রতত্র জেনে না জেনে এন্টিবায়োটিকের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার এর ক্ষতিকর প্রভাব দুধের মাধ্যমে আমাদের দেহে আসতেই পারে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খামারি নিজের অজান্তেই এন্টিবায়োটিক এবং কৃমিনাশক ব্যবহারের পর প্রত্যাহারকাল (Withdrawal period) অনুসরণ না করেই দুধ বাজারজাত করে থাকেন। গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণ ক্ষেত্রে দুধের মধ্যে ক্ষতিকর কোন রাসায়নিকের অবশিষ্ট (Maximum Residue Level- MRL) পাওয়া না গেলেও গাভীর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হলে সেই দুধে উচ্চ মাত্রায় MRL পাওয়া যায়।
দুধ অনিরাপদ হবার এতোসব জানা অজানা বিষয়সমূহ যুক্ত থাকায় নিরাপদ দুধের জন্য একজন সচেতন ভোক্তাকে বিশ্বস্ত সোর্স বা দুধ যোগানদাতা খুঁজে বের করতে হয়। সেই সোর্স কোথা থেকে দুধ সংগ্রহ করে, যাদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে তাঁরা উত্তম কৃষি চর্চা (Good Agriculture Practice -GAP) মেনে গাভী পালন করে কিনা, দুধ দোহন থেকে সরবরাহ পয়েন্ট পর্যন্ত কুল চেইন (Cool Chain) বজায় থাকে কিনা অর্থাৎ দুধ দোহনের পর ২-৪ ঘন্টার মধ্যে চিলিং ইউনিট পর্যন্ত পৌঁছায় কিনা? কারন দুধ দোহনের পর সেই দুধ চিলিং ইউনিট পর্যন্ত পৌঁছতে ৪ ঘন্টার বেশী লেগে গেলে দুধের সর্বোচ্চ শেলফ লাইফ সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে দুধে ক্ষতিকর ব্যকটেরিয়া মাল্টিপ্লিকেশন দ্রুত বাড়তে থাকে। দুধ যে পলি প্যাকেটে বিক্রি করা হয় তা ফুড গ্রেডেড পলি কিনা তাও জানতে হয়। এটা ঠিক একজন সচেতন ভোক্তা সব কিছু জেনেই নিরাপদ দুধ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন। নিরাপদ দুধ সংগ্রহ করার পরও ভোক্তাকে আরো কিছু কাজ সতর্কতার সাথে করতে হয় যেমন- সংগৃহীত দুধ বেশীদিন ফ্রীজে না রেখে ব্যবহার করা, সবচেয়ে ভালো হয় প্রতিদিনের সংগৃহীত দুধ প্রতিদিনই ব্যবহার করে ফেলা। আরেকটা বিষয় হলো দুধ কাঁচা পান না করা, সঠিকভাবে দুধ না ফুটালে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া বিশেষ করে যক্ষা (Tuberculosis) এর ব্যাক্টেরিয়া (Mycobacterium tuberculosis) আমাদের দেহে যক্ষা রোগ তৈরী করতে পারে। সাধারনত কাঁচা দুধ ৯০-১০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাতারায় ১০-১৫ মিনিট জ্বাল দিয়ে ফুটিয়ে নিলে দুধে জীবানু থাকার তেমন সম্ভাবনা আর থাকে না।
গাভী খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে ভোক্তা পর্যন্ত নিরাপদ দুধ নিশ্চিত করার জন্য মাঠ পর্যায় থেকে সরবরাহ পয়েন্ট পর্যন্ত মনিটরিং করার সুব্যববস্থা থাকা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এ মনিটরিং এর কাজটি সরকারী এবং বেসরকারী সংস্থার মাঠ পর্যায়ে যারা নিরিলসভাবে করছেন প্রথমত দায়িত্ব তাঁদের হলেও আসলে এ কাজটি সকল সচেতন ভোক্তারও। সঠিক উপায়ে ঔষুধ সংরক্ষণ, ঔষুধের আয়ুষ্কালের মধ্যে উক্ত ঔষুধ ব্যবহার করা এবং এন্টিবায়োটিক ও কৃমিনাশক ব্যবহারের পর প্রত্যাহারকাল মেনে দুধ বাজারজাত করা, দুধ পরিবহনে প্লাস্টিকের পরিবর্তে মেটাল/ এলুমিনিয়াম পাত্র ব্যবহার করা। মাসে অন্তত একবার গাভীর সিএমটি (California Mastitis Test) পরীক্ষা করা, এন্টিবায়োটিকের পরিবর্তে এ্যালোভেরা, হলুদ এবং চুন দিয়ে মেস্টাইটিস আক্রান্ত গাভীর চিকিৎসা করা। সাইলেজ তৈরিতে ৫% এর বেশি ইউরিয়া ব্যবহার না করা, কারন বেশি ইউরিয়া ব্যবহার করলে আমদের দেহের জন্য ক্ষতিকর ইউরিক এসিড তৈরী হতে পারে। উত্তম কৃষি চর্চা মেনে গাভী পালন করা, গোয়াল ঘর এবং দুধ দোহন শেডিং পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, সমস্ত ব্যক্তিগত ও পারিপার্শ্বিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে দুধ দোহন করা ইত্যাদি বিষয়গুলো মনিটরিং এর মাধ্যমেই নিরাপদ দুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব।
অনেক সময় ভোক্তা চান গোয়ালার সরবরাহ করা দুধ একটু পরীক্ষা করে দেখতে যে দুধে অতিরিক্ত পানি মেশানো হয়েছে কিনা? সেটা অবশ্যই দেখা সম্ভব, একটি ল্যাক্টোমিটার থাকলে দুধে পানি আছে কিনা খুব সহজেই দেখে নেয়া যায়। না থাকলে, অনেক কিছুই আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিও পরীক্ষা (Five Sense Test) দ্বারাই করা সম্ভব। অল্প পরিমাণে দুধ সামান্য ঢালু জায়গায় ঢেলে দিলে যদি খুব তাড়াতাড়ি গড়িয়ে যায়, তাহলে বুঝা যাবে তাতে পানি মেশানো আছে এবং দুধে পানি মিশানো হলে গড়িয়ে যাওয়া পথে তেমন কোন দাগও পড়বে না । দুধ ঘন করার জন্য গোয়ালা দুধে স্টার্চ মিশিয়েছে কিনা তা বুঝার জন্য ২মিলি দুধ ৫ মিলি পানির সাথে মিশিয়ে মিনিট দুয়েক ফোটানোর পর দুধটা ঠান্ডা করে নিয়ে তাতে ২/৩ ফোটা টিংচার আয়োডিনের দ্রবণ মিশালে যদি দুধের রং বদলে নীল হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে দুধে স্টার্চ মেশানো আছে। দুধে ইউরিয়া মেশানো রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য একটা পাত্রে অল্প পরিমাণে দুধ নিয়ে তাতে পরিমাণ মতো সয়া পাউডার মিশিয়ে কিছু সময় পর মিশ্রণটা ভালো করে নাড়িয়ে নিয়ে তাতে একটা লিটমাস পেপার চোবালে যদি লিটমাস পেপারটা ধীরে ধীরে নীল রঙের হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে দুধে ইউরিয়া মেশানো রয়েছে।
একটা পরিবর্তন খুবই দৃশ্যমান, প্রানী সম্পদ অধিদপ্তর, বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থা, প্রাইভেট কোম্পানি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এবং নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আন্দোলনকারী সংস্থা সমুহ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা নিয়ে কাজ করছেন। মানুষের সচেতনতা বাড়ছে, সরকারী-বেসরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর জবাবদিহিতাও বাড়ছে। হ্যাসাপ (Hazard Analysis Critical Control Point – HACCP) ব্যবস্থাপনা অনুসরণ অর্থাৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে সরবরাহ এবং ভোক্তা পর্যন্ত সবগুলো জৈবিক, রাসায়নিক এবং শারীরিক দূষণ বা ঝুঁকি বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে চেষ্টা করে যাচ্ছে। সচেতন ভোক্তারাও যাচাই-বাছাই এর পাশাপাশি তাদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে, নিরাপদ খাদ্য আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে, ভেজাল বিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হচ্ছে এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিমূলক তথ্য তুলে ধরছে।
তাই, সাধারণ ভোক্তারা আশাবাদী হচ্ছেন, তাঁরা নিরাপদ দুধই পান করবেন যেমনটি তাঁরা চান, তাঁদের টেবিলে পৌঁছানো দুধের প্রতিটি ফোটা হবে নিরাপদ আর প্রতিটি চুমুক হবে ভয়হীন-দ্বিধাহীন।
মোঃ মাকসুদুর রহমান
কৃষি উৎপাদন, সরবরাহ শিকল ও নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইলঃ maksudurrahman1363@gmail.com
Leave a Reply