কয়েকদিন ধরে খবরে দেখতে পাচ্ছি আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের রাজধানী দিল্লীতে যমুনার দুই পাড় উপচে পড়া পানি দ্বারা সৃষ্ট বন্যায় প্লাবিত হয়ে পড়েছে। সেখানে রেকর্ড পরিমান অতি বৃষ্টি ও পাশ্ববর্তী হরিয়ানা রাজ্যকে বন্যার হাত থেকে বাঁচাতে বাঁধ খুলে দেয়ার কারনে দিল্লীর এই বিপর্যয় ঘটেছে। আমরা এমন অতি বৃষ্টি, মহাপ্লাবন, মহাখরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দূর্যোগ সমূহ ইদানিংকালে অধিকহারে দেখতে পাচ্ছি। মোটা দাগে এসকল দূর্যোগের মূল কারন প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট করে উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংসের অবশ্যম্ভাবী প্রতিশোধ গ্রহণ! আমরা আমাদের সুবিধার কথা চিন্তা করে যতোই বেশী বৃক্ষ, পাহাড়, প্রাকৃতিক ভূমি বিনষ্ট করতে থাকবো, আমাদের বিরুদ্ধে প্রকৃতি নির্মম প্রতিশোধ নিতেই থাকবে। আমরা প্রাণ হারাবো, স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বো এবং নতুন নতুন বিপর্যয়ের মুখে পড়ে শুধুই আহাজারি করতে থাকবো। খুবই হতাশার ব্যাপার এই যে কার্বন নিঃসরণ বা গ্রীনহাউজ গ্যাস নিয়ন্ত্রণে এখনো পর্যন্ত বিশ্ব নেতেরা সম্মিলিতভাবে উল্লেখযোগ্য কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
মেঘমল্লার হলো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একটি রাগ। একসময় এই রাগ বাজিয়ে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞগণ নাকি বৃষ্টি ঝরাতে পারতেন। ব্যাপারটা কল্পনা করলে এমন দাড়ায় যে একজন শিল্পী আপন ধ্যানে মগ্ন হয়ে খোলা আকাশের নীচে বসে তানপুরাতে মেঘমল্লার রাগ তুলেছেন আর হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ঝরতে আরম্ভ করে দিলো। অসম্ভব রোমান্টিক না হতে পারলে এমন কল্পনাও এখনকার দিনে করার সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রভাবে ঋতুচক্রে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটেছে, নিয়ম করে আর বর্ষা আসে না আষাঢ় শ্রাবণ মাস ধরে। উল্টো এই সময়ে আকাশে ঘনকালো মেঘের পরিবর্তে দেখা যায় কাঠফাটা রোদের মাত্রাতিরিক্ত উত্তাপ। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে কদাচিৎ সত্যতা মেলে। অধিকাংশ সময় অতিবৃষ্টি অথবা অনাবৃষ্টির কবলে পড়ে মানুষের জীবন, প্রকৃতি, কৃষিকাজ সহ সকল প্রকার কর্মকান্ড এলোমেলো হয়ে পড়ে। কোনভাবেই আমাদের শৈশবের দেখা বর্ষার রূপের সাথে মেলানো যায় না কোনকিছুই, হয় বন্যায় ভাসতে হবে অথবা পানির অভাবে গরমের উত্তাপে প্রাণ হবে ওষ্ঠাগত!
বর্ষাকাল জুড়ে আকাশে ভেসে বেড়াবে কালো মেঘের ভেলা, নিয়ম করে নামবে বৃষ্টি, একটানা ৪-৫ দিন অবিরাম ঝরবে বৃষ্টি অঝোর ধারায়। সাময়িকভাবে ফসলের মাঠে পানি জমবে, নদী-খাল-বিল হয়ে উঠবে যৌবনা, প্রকৃতি সবুজে সবুজে সাজবে। মাছেরা প্রজনন কর্মে মত্ত হবে বিল ঝিল হাওড় বাওড় নদীর পানিতে, পেটে ডিম ভরা মা মাছগুলো ডাঙ্গায় উঠে আসবে পানির স্রোতের বিপরীতে।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৯৯৮ সালে আমি বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনিস্টিটিউট, পাইকগাছা, খুলনায় নবীন মৎস্য বিজ্ঞানী হিসেবে যোগদান করে ১২ জুলাই রাতে বৃষ্টির পর চলাচলের হেরিংবোন রাস্তায় উঠে আসতে দেখেছিলাম পেটে ডিম ভরা বিশাল আকৃতির এক ঝাঁক লোনা টেংরা মাছগুলোকে। আর ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে যখন গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া করতাম সেই সময়ে বৃষ্টির পরপরই আমরা স্কুল সংলগ্ন খেলার মাঠে জমে থাকা পানির মধ্যে খালি হাতেই মাছ ধরতে ছুটে যেতাম। ৪-৫ দিন বা কখনো কখনো ৭ দিন ধরে একটানা বৃষ্টি হলেও পানি জমে থাকেনি দীর্ঘসময় ধরে। নদী ও খাল বেয়ে পানি নেমে গেছে আপনাআপনি, সৃষ্টি হয়নি তেমন কোন জনদূর্ভোগ। তাই বর্ষাকাল তখন ছিলো উপভোগ্য যা এখনকার দিনে আতঙ্ক। কারন সামান্য বৃষ্টিতেই অপরিকল্পিত সব স্থাপনা, নদীর তলদেশের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খাল ভরাট বা দখল হবার কারনে জমে যাওয়া পানি আটকে থাকে, সৃষ্টি করে অবর্ণনীয় জনদূর্ভোগ।
ভাঁটির দেশ হিসেবে প্রতি বছর বন্যায় ভাসবে আমাদের নদী খাল বিল সমূদ্র, আপন গতিতে বয়ে যাওয়া সে পানি পলি উপহার দিয়ে আমাদের মাটিকে করবে সোনাফলা। সেটাই তো ছিলো আমাদের চিরকালীন ঐতিহ্যের অংশ, আজ কি দোষে কোন অভিশাপে জলাবদ্ধতা আর বন্যার ছোবলে আমরা হচ্ছি ক্ষতবিক্ষত? শ্রাবণের মেঘমল্লার রাগ এ যুগে আর কাউকে উদ্বেলিত করছে না, সকলের এখন শুধু সম্ভাব্য দূর্যোগ থেকে কোনমতে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের তত্ত্ব অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে এই চিরন্তন সত্য আমরা উপলব্ধি করতে পারলেও কিছুতেই মানছি না। নিজেদের সাময়িক সুখ-স্বাচ্ছ্যন্দের মোহে পড়ে নির্বিচারে ধ্বংস করছি পরিবেশ, রাখছি না বন্যার পানি সরে যাবার প্রাকৃতিক জলাধারগুলো, উল্টো সেগুলো ভরাট করে গড়ে তুলছি অট্টালিকা ইমারত। আবার আমরাই বন্যায় ভেসে গিয়ে করছি শাপশাপান্ত, দোষ চাপাচ্ছি একে অপরের ঘাড়ে, কিন্তু চালিয়ে যাচ্ছি প্রকৃতি ধ্বংসযজ্ঞ নির্বিচারে। এই মরণ আমাদের মেনে নিয়েই বাঁচতে হবে, এই বাংলায় ভরা বরষায় আর কাব্য নয় বরং বৃষ্টির রিমঝিম শব্দের পরিবর্তে শুনতে পাবো দূর্যোগাক্রান্ত মানুষের হাহাকারের অব্যক্ত আর্তনাদ!
পল্লব খন্দকার, ১৪ জুলাই ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply