আপনাকে কিন্তু খুবই হুশিয়ার হইতে হইবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথা কইতে বা লিখিতে চাহিলে। কেননা কি হইতে কি হইবে আপনি তাহা অনুমান করিতে পারিবেন না, আপনার একটু বাঁকা চোখের ইশারায় যদি নেটিজেনরা মাতিয়া ওঠেন তাহা হইলেই আপনি কিন্তু ভাইরাল হইয়া পড়িলেন। আপনি না জানিয়াই পরেরদিন পত্রিকায় নিজের ভাইরাল খবরটি দেখিয়া চমকাইয়া উঠিতে পারেন। যেমন ভুবন বাদ্যকর ঘূর্নাক্ষরেও জানিতে পারেন নাই পাড়াগাঁয়ে খুবই ক্ষুদ্র একটি ব্যবসার প্রচারে তাঁহার খালি কন্ঠে গাওয়া “বাদাম বাদাম, কাঁচা বাদাম” গানটি গাহিয়া তিনি দুই বাংলায় ভাইরাল হইয়া পড়িতে পারেন। তিনি নিজেও তাহা চাহেননি কস্মিনকালে, তিনি জীবনে স্মার্ট ফোনই ব্যবহার করেননি, সাধাসিধা মানুষ হিসেবে গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বাড়ি বাড়ি গিয়া বাদামের বিনিময়ে বিভিন্ন পুরাতন লোহা লক্কড় ও প্লাস্টিক পণ্য আদান প্রদানের ব্যবসা করিতেন মাত্র। তাঁহার সামান্য আয়ে সংসারই ঠিকমতো চলিতো না, তাই ভাইরাল হইবার শখের চাইতে তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষনের পথটি ছিলো অভিনব, কেহ একজন তাহা ভিডিও করিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা মাত্রই ভিডিওটি দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িয়া ভাইরাল হইয়া পড়িলো, তিনি রাতারাতি বনিয়া গেলেন সেলিব্রেটি!
সাধু ভাষা ব্যবহার করে একটু ভাইরাল হবার চেষ্টা করলাম আমি! যদিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এইসব ভাইরাল বিষয়গুলো আমার কাছে ভাইরাল ফিভারের মতোই মনে হয়। এগুলোর মাত্রারিক্ত প্রসার, বিকৃতি, আলোচনা, সমালোচনা, হাস্যরস উৎপাদন করার ব্যাপারটিতে কেমন যেন একটা আলগা ভাব, খামখেয়ালিপনা ও অবিবেচক মশলার ঘ্রাণযুক্ত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম পূর্ববর্তী যুগে আশি নব্বইয়ের দশকে “হাওয়া হাওয়া, ও হাওয়া” উর্দু বা হিন্দি গানটি এই উপমহাদেশ জুড়ে জনপ্রিয় হয়েছিলো! আমি কিন্তু ভাইরাল বলিনি, বলেছি জনপ্রিয়, আমাদের শৈশবেও আপনমনে গেয়ে উঠতাম গানটি। আরো মনে আছে আমাদের গ্রামের দিকে “না রে জরিনা, আমি কি তোর আপন ছিলাম না” গানটিও মুখে মুখে ফিরতে। “বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না” ছায়াছবিটির জনপ্রিয়তা তো কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছে যেতে দেখেছি, “বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না আমায় কথা দিয়েছে” গানটি দেশের প্রতিটি কোণে কোণে বাজতে শুনেছি, মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়তেও দেখেছি। সেগুলোকেও আমরা ভাইরাল বলিনি, বলেছি জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে বা বহুল প্রচারিত হয়েছে।
তাহলে ভাইরাল আসলে কি?
ভাইরাসকে বলা হয় জীব ও জড়ের বৈশিষ্টের সমন্বয়ে গঠিত জীবম্মৃত একটি বস্তু বা কণা। এটি এতোই ক্ষুদ্র যে শক্তিশালী মাইক্রোসকোপ ব্যতিত দেখা সম্ভব নয়। এটিকে প্রাণীও বলা যায় না, আবার উদ্ভিদও নয়, কারন ভাইরাসের কোষ পরিপূর্ণ নয়, শুধুমাত্র উপযুক্ত তাপমাত্রা, খাদ্য, পোষক বা পরিবেশ পেলেই এরা জীবের মতো আচরণ করতে থাকে। এমনকি প্রজনন ঘটাতেও সক্ষম হয়ে পড়ে, এদের প্রজনন বা বংশ বৃদ্ধি ঘটে জ্যামিতিক হারে অর্থাৎ একটি ভেঙ্গে দুইটি, দুইটি ভেঙ্গে চারটি, চারটি ভেঙ্গে আটটি এভাবেই অনির্দিষ্টভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ তার বৃদ্ধির উপযুক্ত পরিবেশ বজায় থাকে। ভাইরাস দ্বারা ঘটিত কোন রোগের নিরাময়ে বা চিকিৎসায় ঔষধ ব্যবহার করে ফল পাওয়া যায় না, বরং ঐ নির্দিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরে ইম্যুনিটি বৃদ্ধি করতে হয়। ভাইরাস ঘটিত রোগের প্রতিরোধক হিসেবে বিভিন্ন টিকার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সম্প্রতি আমরা বিশ্ব জুড়ে করোনা মহামারী দেখেছি, টিকা আবিষ্কারের পরপর এর প্রাদূর্ভাব অনেকাংশে হ্রাস করা সম্ভবপর হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বহুল প্রচারিত বা দর্শক বা পাঠকের ভিউ এর উপর ভিত্তি করে একটি বিষয়কে ভাইরাল বলা হয় এই কারনে যে ভাইরাসের বৃদ্ধির মতোই সেগুলোর দ্রুত ভিউ বৃদ্ধি পায় এবং বহুল প্রচারিত হয়। তাই আগের যুগে যাকে জনপ্রিয় বলা হতো এ যুগের প্রজন্মের কাছে হালনাগাদ শব্দটি হচ্ছে ভাইরাল। যা অনেকে অনেক কসরত করেও হতে পারেন না, আবার অনেকে নিজের অজান্তেই হয়ে যান, এখানে সাধনা বা গুনগত মান বজায় রাখার কোন বিষয় মূখ্য নয়।
আমি ব্যক্তিগতভাবে এ যুগের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামের ভাইরাল বিষয়গুলো বাধ্য হয়ে অবোকন করি কিন্তু কোনভাবেই সবার সাথে তাল মিলিয়ে সুর মিলিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না ভাইরালের পিছনে। অনেক ভাইরাল বিষয় বা কন্টেন্টগুলো আমার কাছে একদমই অর্বাচীন, অপ্রয়োজনীয়, অস্বাভাবিক, অন্তরসারশূন্য মনে হয়। মানুষকে বিনোদনের নামে জোর করে সুড়সুড়ি দেবার ব্যাপারটি খুবই প্রচ্ছন্নভাবে ফুটে ওঠার পরও বিষয়গুলো ভাইরাল হয়। মানুষ সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, ট্রল বা বিদ্রূপ ইত্যাদি কর্মকান্ডে মেতে ওঠে। এরপর হঠাৎ কি হয় জানেন? মানুষ বেমালুম ভুলে যায়, হাজার খুঁজেও পাওয়া যায় না টাইম লাইনে, পেলেও তা আর মানুষকে সুড়সুড়ি দিতে পারে না। মানুষ সেগুলোকে ফালতু বলে সামনে থেকে সরিয়ে দেয় যা কিছুদিন আগেই তাঁদের কাছে তুমুল আগ্রহের ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হতো। মানুষের এমন ব্যাপক উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়া আবার দুদিন বাদে বেমালুম ভুলে যাবার বিষয়টি আমার কাছে জটিল ধরণের মানসিক সমস্যা বলে মনে হয়!
আসলে গুনগতমান ছাড়া কোনকিছুই মানুষের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারে না। বর্তমান সময়টা হয়ে গেছে জিপিএ-৫ বা গোল্ডেন ফাইভের যুগ, কোয়ালিটি এখন গণ্য, সংখ্যাটাই এখন মূখ্য। এভাবে আমাদের সমাজ ও সংষ্কৃতি জগত ভাইরালের কবলে পড়ে হয়তো একটা অস্বাভাবিক অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। এই সস্তা ভাইরালের সংষ্কৃতি রুখতে না পারলে সত্যি সত্যি আমরা ভাইরাল ফিভারে আক্রান্ত হয়ে যাবো, তখন হাজারো গুনগত মানসম্পন্ন বিষয়গুলোতেও কারো মনোযোগ আর থাকবে না। আমরা হয়ে যাবো চির বন্ধ্যা, চির অমাবশ্যায় ঢেকে যাবে আমাদের আনন্দ বেদনার বিশাল আকাশ!
পল্লব খন্দকার, ০৮ আগস্ট ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply