“ব্যবহারে বংশের পরিচয়” বাক্যটি একসময় প্রায়শই বিভিন্ন যাত্রী পরিবহনে লেখা দেখতাম। এর কারন সম্ভবত যাত্রীদের সাথে ভাড়া নিয়ে বসচা যাতে না হয় সেটারই সতর্কবার্তা হিসেবে লেখা। ব্যবহার খারাপ করলেই আপনি কিন্তু ভালো বংশের মানুষ না বলে প্রমাণিত হবে, অতএব সাবধান, ব্যবহার ভালো করুন, বংশের মর্যদা রক্ষা করেন দয়া করে। অনেক সময় দুইজন মানুষের ঝগড়ার সময়ও দেখেছি রাগান্বিত হয়ে একজন আরেকজনকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে আপনার ব্যবহার দেখে মনে হচ্ছে আপনার বংশ ভালো নয়! কারন প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ নিজের বাবা-মা আর বংশের পরিচয়ের ব্যাপারটিকে স্পর্ষকাতর হিসেবে দেখে। কেউ তাঁর বংশ বা বাবা-মা তুলে অশালীন কথা বললে কিছুতেই সহ্য করতে চায় না, তীব্র প্রতিবাদ করে জানিয়ে দেয় যে আমার বাবা-মা ও বংশ দুটোই অন্যের চেয়ে ভালো।
প্রশ্ন হলো এই বাক্যটি কি এখন আর খুব বেশি প্রাসঙ্গিক? “ব্যবহারে বংশের পরিচয়” বাক্যটি কি নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারছে এ যুগে? আমি কিন্তু এখন খুঁজেই পাই না আর এই বহুল চর্চিত বাক্যটির উপযোগিতা!
ভালো ব্যবহার বলতে আসলে আমরা কি বুঝি?
সুন্দর ব্যবহার ও আচার-আচরণ বলতে আমরা বুঝি কারও সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলা, দেখা হলে সালাম দেওয়া, কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, কর্কশ ভাষায় কথা না বলা, ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত না হওয়া, ধমক বা রাগের সুরে কথা না বলা, পরনিন্দা না করা, অপমান-অপদস্ত না করা, উচ্চ আওয়াজে কথা না বলা, গম্ভীর মুখে কথা না বলা, সর্বদা হাসিমুখে কথা বলা, অন্যের সুখে সুখী হওয়া এবং অন্যের দুঃখে দুঃখী হওয়া। এছাড়া কারও বিপদে দেখা করে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ করাও সুন্দর আচরণের অন্তর্ভুক্ত।
ভালো বংশ বলতে কি বোঝায়?
যে বংশের ভদ্রতা প্রদর্শনের দীর্ঘদিনের ইতিহাস আছে, হতে পারেন তাঁরা অনেক টাকাওয়ালা ধনী অথবা সম্পদহীন দরিদ্র। তবে একটা ব্যাপারে তাঁরা সমান তা হলো নিজের বংশের সবাই সমাজের সকলের সাথে ভদ্রতা বজায় রেখে চলেন, তাঁদের বংশের সবাইকে একবাক্যে সকলে ভালো বংশ বলে স্বীকার করেন। তাই ভদ্রতা বিষয়ে কিছু জানার চেষ্টা করি এবার। কোথাও কোথাও আমরা লেখা দেখে থাকি ‘ভদ্রতা বংশের পরিচয়’। একজনের আচরণে ভদ্রতা কতটুকু তার সাথে মানুষের বংশের পরিচয়টি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ভদ্র ব্যবহারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো অন্যকে সম্মান প্রদর্শন, নিজেকে হামবড়া হিসেবে প্রকাশ না করা এবং নিচুস্বরে কথা বলা বা চিৎকার চেঁচামেচি না করা। খুব অল্প কয়েকটি আচরণ দিয়েই আমরা সহজেই একজনের ভদ্রতার মাত্রা ও বংশের পরিচয় কিন্তু পরিমাপ করে ফেলতে পারি।
অন্যদিকে একটি কবিতার লাইন আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে বংশ দিয়ে ব্যবহার বা ভদ্রতার পরিমাপ করার সুযোগ কম বরং ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো’ এটাই মূল কথা। কেননা আমি নিজে খন্দকার বংশের একজন সন্তান, খন্দকার বংশের ঐতিহ্য হলো সুশিক্ষা অর্জন এবং সেটি অন্যদের মাঝে পৌঁছে দেয়া। যিনি সুশিক্ষা অর্জন করতে পারবেন তিনি আপনাআপনি ভদ্রতা অর্জন করবেন। কিন্তু আমি আমার বংশসহ বহু সৈয়দ, শেখ, মোল্লা, গাজী, হাজী সকল বংশের মানুষদেরই কাছ থেকে দেখেছি। আমার বর্তমান অভিজ্ঞতা বলে “ব্যবহারে বংশের পরিচয়” বা ‘ভদ্রতা বংশের পরিচয়’ কথাগুলো এ যুগে আর চলে না। আমার বংশেই দেখেছি বা দেখছি অশিক্ষিত, মিথ্যাবাদী, ছলচাতুরীতে পারদর্শী বহু বহু কুলাঙ্গার! বংশের দোহাই দিয়ে হেন কোন অনৈতিক কার্য নাই যে উচ্চ বংশীয়রা আজকাল করেন না। বরং শিক্ষিত সজ্জন হিসেবে পরিচিত মানুষেরাই মিষ্টি ভদ্রতার আড়ালে চুরি চামারী দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন দেদারছে। তাই “ভদ্রতা চোরের পরিচয়” বল্লেও এখন অত্যুক্তি হয় না!
আর এক ধারার মানুষ দেখেছি যারা বাইরের মানুষদের সাথে মধু মিশ্রিত আচরণ করেন, বাইরে থেকে দেখে তাঁদের মত ভদ্দরলোক আপনি এই ভূমন্ডলে একজনকেও খুজে পাবেন না। দূর্ভাগ্যক্রমে যদি আপনি সেই পরিবারের আত্মীয় হন বা খুব কাছ থেকে পরিবারের অভ্যন্তরে তাঁর আচরন দেখার সুযোগ হয় তাহলে বিস্ময়ে আপনি নিশ্চিত ভিমরী খাবেন। আমাদের দেশের একটি নামকরা বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর পরিবারের একটি অংশের সাথে কিছুদিন ঘনিষ্টভাবে কাজ করার সুযোগ ঘটেছিলো আমার। তথাকথিত সেই উচ বংশীয় শিল্প পরিবারের সদস্যদের বাড়িতে পরষ্পরের সাথে আচরণ যদি আপনি দেখেন তো শুধুমাত্র মনে হবে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে। নিজ পরিবারের মানুষের সাথে এহেন জঘন্য শব্দ প্রয়োগ কিভাবে হতে পারে তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। এমনকি আমি আমারই ঘনিষ্ট আত্মীয়দের বাড়ির ভিতরের আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছি বহুবার। তাঁদের এরূপ নগ্ন বাক্যবান ও অশালীন আচরণের বহিঃপ্রকাশ যখন ঘটে তখন শব্দের সাথে পরিবেশও নিশ্চিত দূষিত হয়ে পড়ে। এদের যখন রাগ মাথায় উঠে যায় তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন এবং স্থানকাল পাত্র ভুলে গিয়ে কাকে কি বলছেন তারও কোন হিসাব থাকে না। সেখানে মুরব্বী বা শিশু কেউ উপস্থিত আছে কিনা সে হুস রাগান্বিত ব্যক্তিটির আর থাকে না। অথচ বাইরে বের হয়েই অন্যদের কাছে তাঁর মত সুব্যবহার সম্পন্ন মানুষ আর কেউ হয়ই না? এরা মোটেই সুস্থ মানুষ নন, এরা দ্বি-চারী, দু-মুখো সাপের চেয়েও ভয়ংকর, কারন পরিবারের অভ্যন্তরে নিজেদের এমন নিম্ন রুচির আচরণ তিনি অব্যাহত রাখেন, জীবনেও সেজন্য অনুতপ্ত হন না।
আসুন ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোন থেকে ভালো আচরণ বা ভদ্রতা সম্পর্কে কিছু জেনে নিইঃ
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন মুমিনের আমলনামায় সুন্দর আচরণের চেয়ে অধিক ভারী আমল আর কিছুই হবে না। যে ব্যক্তি অশ্লীল ও কটু কথা বলে বা অশোভন আচরণ করে, তাকে আল্লাহতায়ালা ঘৃণা করেন। আর যার ব্যবহার সুন্দর, সে তার ব্যবহারের কারণে নফল রোজা ও তাহাজ্জুদের সওয়াব লাভ করবে। ’ -সুনানে তিরমিজি
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে তা হলো- আল্লাহতায়ালার ভয় ও সুন্দর আচরণ। আর সবচেয়ে বেশি যা মানুষকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবে তা হলো- (মানুষের) মুখ এবং লজ্জাস্থান। ’ -সুনানে তিরমিজি
হজরত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সুন্দর আচরণই নেক আমল। ’ –সহিহ মুসলিম
হাদিসে রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার আচার-ব্যবহার সুন্দর, সে আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয় এবং কিয়ামতের দিন সে আমার সবচেয়ে কাছে থাকবে। ’ -সুনানে তিরমিজি
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও ইরশাদ করেন, ‘অশোভন-অশ্লীল কথা ও আচরণের সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। আর যার আচরণ যত সুন্দর তার ইসলাম তত সুন্দর। ’ -মুসনাদে আহমদ
হজরত রাসূল (সা.) আরও বলেছেন, ‘যদি কেউ বিনম্রতা ও নম্র আচরণ লাভ করে, তাহলে সে দুনিয়া ও আখেরাতের পাওনা সব কল্যাণই লাভ করল।’ –আহমদ
অথচ আমার দেখা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ুয়া ব্যক্তি অথবা পবিত্র হজ্জব্রত পালন করে এসেও অধিকাংশ মানুষই নিজেদের অসুন্দর আচরণগুলো পরিবর্তন করতে পারেন না, ব্যাপারটা আমার কাছে রীতিমতো বিস্ময়ের!
পল্লব খন্দকার, ২১ আগস্ট ২০২৩।
Leave a Reply