বডি সেমিং কি?
ইদানিং যখনই পরিচিত বা অপরিচিত জনের সামনে যাই অথবা ফেসবুকে ছবি পোস্ট করি, একটা কথা প্রায়শই শুনি আপনি মোটা হয়ে যাচ্ছেন। তথাকথিত আপনজনেরাও কম যান না, বলেন আচ্ছা কোন গুদামের চাল খান ইত্যাদি টাইপের কথা। আর সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় হলো এনারা কথাগুলো সর্বসম্মুখে একরাশ তৃপ্তি নিয়ে বলেন!! আর আমি তখন স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে সেটা মেনে নেই। হয়তো আমি সহনশীল বিধায় হাসিমুখেই মেনে নিলাম। ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখলাম আবার সম্প্রতি। এক ছোট বোন সুন্দর এক ছবি পোস্ট করেছে। সবাই মোটামুটি একমত যে ছবিটি বেশ চমৎকার। বেরসিক একজন মন্তব্য করলেন, তার জিমে যাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন, নচেৎ ছবি ভালো না আসার সম্ভাবনা। সঙ্গে তাল মিলিয়ে এলেন আরেকজন। লিখেছেন মুদি দোকানের ঠিকানাটা দিবেন প্লিজ!! এখন তাদের কাছে মনে হতেই পারে, তারা সমাজ সেবা করছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে তারা যেটা করছেন, সেটার একটা নাম আছে—Body Shaming বা শরীর নিয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য। ইংরেজিতে আরো পরিষ্কার সংজ্ঞা আছে “The action or practice of mocking or stigmatizing someone by making critical comments about the shape, size, or appearance of their body.”
এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী এই বডি শেমিং করলেই বা সমস্যা কী? সংজ্ঞা অনুযায়ী আপনি যদি কারও দেহের আকার, আয়তন বা ওজন নিয়ে প্রকাশ্যে এমন কোনো সমালোচনা বা মন্তব্য করেন যাতে সেই মানুষটি লজ্জাবোধ করেন বা অপমানিত হন, তবে তা বডি শেমিং। সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হচ্ছে হাতি, মোটকা, শুঁটকো ও বাটকু ইত্যাদি নামে মানুষকে ডাকা। তবে আরও ভয়াবহ উদাহরণ হচ্ছে, ‘এই তাল পাতার সেপাই, তোর দিকে কোন মেয়ে তাকাবে রে?’ বা ‘সুমো পালোয়ানও তো তোকে দেখে লজ্জা পায়, সারা জীবন তুই তোর বাপের কাঁধের বোঝা হয়ে থাকবি।’ ভয়াবহ উদাহরণগুলোই কমন বেশি। মানুষজন এত অবলীলায় বলেন যে মনে হয় সামনের জন বুঝি অনুভূতিশূন্য।
শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ কেউ হয়তো ভুরু কুঁচকাবেন, ‘আরে আমি তো ওর ভালোর জন্যই বলি, তোমরা না শুধু শুধু ভুল বোঝো। বললেই তো সে বেশী করে শুকানোর জন্য চেষ্টা করবে’। ভুল, মানুষের এমন ধারনাগুলো একেবারেই ভুল। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ক্যানসার রিসার্চ টিম এই প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা করে বের করেছে ফ্যাট শেমিং কোনো উপকার তো করেই না, উল্টো ওজন বাড়িয়ে স্থুলতার দিকে ঠেলে দেয়। অপমানজনক কথা শোনার জন্য মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে খাবারের মাঝে সান্ত্বনা খোঁজে এবং পরিণামে ওজন বেড়ে চলে। বডি শেমিংয়ের আরেকটা ভয়াবহ ফলাফল হলো আত্মবিশ্বাসহীনতা। প্রতিনিয়ত নেগেটিভ মন্তব্য শুনতে শুনতে একপর্যায়ে মানুষ সেটাই বিশ্বাস করা শুরু করে এবং ফলাফল হচ্ছে ডিপ্রেশন, বুলেমিয়া নার্ভোসার মতো মানসিক ব্যাধি যার সঙ্গে আসে পুষ্টিহীনতাসহ আর অনেক অসুখ। কেউ কেউ ইয়াবা সহ বিভিন্ন ধরনের ড্রাগস খাওয়া শুরু করে শুধুমাত্র শুকানোর জন্য। কিন্তু আর ফেরত না আসতে পেরে নিজের, পরিবারের তথা সমাজের জীবন ধ্বংস করে দেয়।
বডি শেমিং নিয়ে আরও কথায় যাওয়ার আগে একটা প্রশ্ন যেটির শুরু মানবজন্মের গোড়া থেকে, সেটি নিয়ে কথা বলা যাক। বাহ্যিক সৌন্দর্য আসলে কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এখনকার দিনে অনেক প্রগতিশীল নরনারী পাত্র বা পাত্রী দেখতে যাওয়ার সময় বলে থাকেন বটে, বাহ্যিক সৌন্দর্য আসলে কোনো বিষয়ই না, মনটাই আসল। তারপরেও যাকে দেখতে যান তাকে নাকচ করে দেন ‘মানসিকতায় মিলবে না’ এমন ওজর দেখিয়ে। তবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে এক সময়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বীকার করে বসেন, যাকে দেখতে গিয়েছেন তার চেহারাটি ভালো লাগেনি। কাউকে যদি ভালো না লাগে তবে এতে আমি কোনো অপরাধ দেখি না। মানুষ বৈচিত্র্যময়, ব্যক্তিগত পছন্দের কোনো মাপকাঠি নেই। ধরুন যে চোখ জোড়া আপনার কাছে রাগী মনে হয়েছে সে দুটি চোখই অন্যের কাছে মনে হবে বিষাদগ্রস্ত। তবে সমস্যা তখনই শুরু হয় যখন আপনি আপনার পছন্দকে অন্যের ওপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ আপনি সেই পাত্র বা পাত্রীকে বিয়ে তো করলেন বটে পরিবারের মান রাখতে অথবা তার টাকা কিংবা মাস্টার্স ডিগ্রি দেখে, কিন্তু তাকে আপনার মনের মতো করে গড়ে তুলতে দিনরাতে তাকে খোঁটা দেওয়া শুরু করলেন। বাহ্যিক সৌন্দর্য অবশ্যই হেলা ফেলার বিষয় নয়। কিন্তু সেটিকে পেতে যদি আপনার মরিয়া মনোভাব সৃষ্টি হয়, অন্তর কলুষিত করতে হয় তবে সে সৌন্দর্য থেকে দূরে থাকাই উত্তম।
আপনি যদি ভেবে থকেন যে আপনার এ রকম আচরণে আপনার জীবনসঙ্গী অথবা সঙ্গিনী ছাড়া আর কারও ওপর প্রভাব পড়ছে না, তবে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। প্রতিটি মানুষ সমাজের আরও অসংখ্য মানুষের সঙ্গে জড়িত। আপনি একজনকে মানসিক আঘাতে জর্জরিত করা মানে আপনার পরবর্তী প্রজন্মকেও আত্মবিশ্বাসহীনতায় ঠেলে দেওয়া।
আমাদের দেশে আজকাল ভালোবাসার সম্পর্কগুলোতেও বডি শেমিংয়ের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব রাখছে। অনেকের মধ্যেই একটি মনোভাব কাজ করে- আমার পার্টনারের যদি জিরো ফিগার থাকতো বা জিম করা পেশীবহুল ফিগার থাকতো, তাহলে কী ভালোই না হতো! আসলে ফিগারের এই ব্যাপারটিকে এত বেশি হাইলাইট করা হয় যে ফিগার আর চেহারা সুন্দর করতে আদাজল খেয়ে লাগছেন অনেকেই। শুধুমাত্র ২০১৬ সালেই আমেরিকাতে প্রায় ৪২ লক্ষ মানুষ প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছেন চেহারা সুন্দর করতে এবং স্তনের আকৃতি বৃদ্ধি করতে। ১৮ বছরের কম বয়সী অনেকেও স্বেচ্ছায় নিজেদের এই কাটাছেঁড়ার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছেন। ভিয়েতনামে অনেক মা মেয়ের জন্মদিনে উপহার হিসেবে প্লাস্টিক সার্জারি করাচ্ছেন! এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে ভালোবাসার মানুষের উপর দোষ চাপিয়েই বা কী লাভ?
২০১৩ সালের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী ইউটিউবে সবচেয়ে বেশি যে ভিডিও আপলোড হয় সেটি হচ্ছে—‘am I pretty or ugly’ এবং এগুলো আপলোড করেছে ৯-১৮ বছর বয়সী বাচ্চারা। কেমন হবে যদি অন্যের সম্পর্কে করা আপনার মন্তব্যগুলো আপনার আদরের সন্তানটি শুনে সে নিজেও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে অপরিচিত মানুষের কাছে নিজের চেহারার ভ্যালিডেশন চায়? এখনো কি বলবেন, আপনার করা নেতিবাচক মন্তব্যে কারও কোনো ক্ষতি হবে না?
এই বডি শেমিং কারা করে? আমার মনে হয় তিন ধরনের মানুষ এটা করে থাকেঃ
# ভীষন রকম ভাবে হীনমন্যতায় ভোগা মানুষ যারা আরেকজনের মনে আঘাত দিয়ে শান্তি লাভ করে।
# অবুঝ মানুষ যারা একটা কথা বলার পরে তার কী ফলাফল হতে পারে তা বুঝতে অক্ষম অথবা অরাজি।
# সত্যিকারের খারাপ মানুষ যারা কোনো কারণ ছাড়া মানুষের মনে কষ্ট দিতে ভালোবাসেন।
আমরা বেশির ভাগ মানুষ দুই নম্বর গোত্রে পড়ি। একটা কথা বলার পরে সেটার পরিণতি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। বিশেষ করে বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কথা বলার সময় অপরপক্ষে যিনি বসে আছেন, তাকে মানুষ বলে ভাবার প্রয়োজনীয়তা সব সময় বোধ করেন না। ব্যাপারটি অনেকটা এ রকম—চোখে তো আর দেখতে পাচ্ছি না, ক্ষতি কী যা খুশি তাই বললে? কিন্তু কথার প্রভাবে কত দূর কী হতে পারে সে বিষয়ে নিক ভুজিসিকের একটা কথা আমি বলতে পারি। সেটা বলার আগে নিক ভুজিসিকের সঙ্গে একটু পরিচয় করিয়ে দিই। শারীরিকভাবে অক্ষম নিক একজন মোটিভেশনাল স্পিকার ও লেখক যার জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। দুর্ভাগ্যবশত নিকের জন্ম হয় হাত ও পা ছাড়াই, খুবই দুর্লভ একটি জন্মগত ত্রুটি যার নাম Tetra-amelia syndrome। যেখানে হাত-পাসহ মানুষেরাই প্রতিনিয়ত সমালোচকদের তির্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হয় সেখানে বাল্যকাল থেকে নিকের কী অবস্থা হয়েছিল সেটা না বললেও চলে। মাত্র দশ বছর বয়সেই নিক একবার আত্মহত্যার চেষ্টা চালায়। যা হোক, নিক বলেছিল, ‘কেউ যখন শারীরিক কোনো বিষয় নিয়ে তির্যক মন্তব্যের শিকার হয়, সে এক পা এক পা করে খাদের দিকে এগিয়ে যায়। খাদের এপারে জীবন, ওপারে আত্মহত্যা। তুমি হয়তো ভাবছ যে তোমার একটা টিটকারিতে কিই–বা এসে যাবে। কিন্তু যাকে বলছ হয়তো সে অনেকের টিটকারি শুনতে শুনতে খাদের কিনারাতেই দাঁড়িয়ে ছিল, তোমার একটি তুচ্ছ মন্তব্যের জন্যই সে হয়তো আজ রাতে খাদের ওপাশে লাফিয়ে পড়বে। তুমি জানলেও না যে পরোক্ষভাবে তুমি একটি জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী হলে।’ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে কেমন শোনায় ব্যাপারটা?
কিন্তু তাই বলে কী আমরা হাসি, মজা করব না? বন্ধুকে তো আমরা কত কিছুই বলি। এসব কী আর কেউ মন থেকে বলে নাকি? না, আসলে সবকিছু আমরা মন থেকে বলি না। কিন্তু বাসা বা বাইরে বন্ধুদের আড্ডায় বলা এক জিনিস, আর ফেসবুকে অথবা জনসম্মুখে বাজে ভাবে মন্তব্য করা আরেক। কেন? কারণ ফেসবুক পাবলিক। আপনি যে মন্তব্যটি করবেন সেটি আপনার বন্ধু যেমন দেখবেন, বন্ধুর বড় ভাইবোন এমনকি তার বাবা-মা পর্যন্ত দেখতে পারেন। আপনার মন্তব্য যে বন্ধুসুলভ তা যদি পড়ে বোঝা না যায়, তবে আপনি তার পরিবারসহ সকলকেই কষ্ট দিলেন। আমার যে ছোটবোনের ছবিতে আপনি এমন বাজে মন্তব্য করে ভাবলেন কাহিনি শেষ— তবে আমার জন্য কিন্তু শেষ হলো না। সে আমার বোন, আমি জানি তার ইতিহাস। আপনি জানেন না।
তবে কি কিছু বলতেই পারব না? এমন যদি হয় যে সে আমার আপনজন আর আমি তার ভুল না ধরলে কেউ ধরবে না? অথবা সে এমন ছবি দিয়েছে যা দেখতে দশজনের চোখে খারাপ লাগছে? সমাধান তো ফেসবুক দিয়েই রেখেছে, ইনবক্স করুন। ব্যক্তিগত মেসেজে তাকে জানান আপনার উপদেশ। সেও তার ভুল বুঝল, দশজনের সামনে অপমানিতও হলো না আর আপনিও আপনার কর্তব্য করলেন। ভরা আড্ডার আসরে তির্যক মন্তব্যে কোনো ব্যক্তিকে অপমানিত করলে আপনার মতোই অন্য কাউকে হয়তো ক্ষণিকের আনন্দ দিতে পারবেন, তবে তার থেকে বহুগুণে আপনি মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হবেন যদি তাকে ব্যক্তিগতভাবে আপনার মতামত সহানুভূতিশীল সুরে জানান।
কিছু মানুষ প্রশ্ন রাখেন, যদি আপনজন না হয় তবে? সে ক্ষেত্রে আমি আপনার কাছে প্রশ্ন রাখব, আপনি যে অপরিচিত মানুষটির অদ্ভূত সাজপোশাকের ছবির সঙ্গে আজেবাজে মন্তব্য জুড়ে সবাইকে দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন, এতে কার কী উপকার হচ্ছে? আপনি শেয়ার দেওয়ার আগে ছবিটি হয়তো দেখেছিলেন দশজন ব্যক্তি, আপনার কারণে দেখলেন আরও একশো জন। একজন অতি রূপবান ব্যক্তিরও অসতর্ক মুহূর্তে তোলা ছবিতে তাকে দৃষ্টিকটু দেখাতে পারে। অতএব কী দরকার আরেকজনকে মানসিকভাবে কষ্ট দেওয়ার? এড়িয়ে যান ছবিটি অথবা কোনোভাবে সেই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের উপায় থাকলে প্রাইভেট মেসেজ রাখুন, যাতে তিনি ছবিটি সরিয়ে ফেলতে পারেন। দেখুন ঠিক কাজ করা পৃথিবীতে কোনো দিনও সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরেও যুগে যুগে অসংখ্য মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের লোকসান করে হলেও সঠিক পথটি বেছে নিয়েছেন বলেই আজকে আমি, আপনারা সবাই এত দূরে এসেছি। এবারে আমাদের অন্যকে পথ দেখাবার পালা।
মানুষের মন ভালো করার কাজ যদি অনেক কঠিন ও কষ্টকর মনে হয়, তাহলে সহজ কাজটিই করুন—দয়া করে কারও মন খারাপ করিয়ে দেবেন না। Please Stop Body Shaming.
সংকলনঃ বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।
দৈনিক আলোকবর্তিকা ডেস্ক।
Leave a Reply