শিক্ষাকে কোনভাবেই পণ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। অথচ আমার অভিজ্ঞতা দেখেছে আজকালকার দিনে শুধু শিক্ষকরাই কোচিং বানিজ্যের সাথে জড়িত নন বরং সমাজপতিরাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বানিজ্যের সাথে তীব্রভাবে জড়িয়ে পড়ছেন। দেশের শতভাগ বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পরিচালনা পর্ষদ নামে যে কাঠামোটি বিদ্যমান আপনি ধরে নিতে পারেন তাঁরা মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার উন্নয়নের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতার বাহাদুরি দেখানো এবং নিয়োগ বা কোন শিক্ষা স্থাপনা তৈরিতে কমিশন বানিজ্যে অধিকতর মনোযোগী। আমি নিজের শৈশবের স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষকের সীমাহীন নৈরাজ্য নিয়ে ফেসবুকে অনেক লেখালেখি করে ও মানুষের প্রতিক্রিয়া থেকে যেটুকু বুঝেছি সেটি পুরো দেশের প্রেক্ষাপটে আমাকে চরম নৈরাশ্যবাদী করে তুলেছে। সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই নাকি একই চক্রের কবলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কারন সমাজপতিদের সবচেয়ে নষ্ট অংশের ধান্দবাজ মানুষগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছেন। বর্তমান শিক্ষকেরাও সেই নষ্ট চক্রের তপ্লিবাহক হয়ে সমর্থন করে যাচ্ছেন অনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে।
এই সুযোগে বিদ্যালয়গুলোতে কাড়ি কাড়ি টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পেয়ে যাচ্ছে শিক্ষকতার মহান আদর্শের অযোগ্য জনবল। তাঁরা শিক্ষকতার মত মহান পেশার প্রতি নূন্যতম অঙ্গীকারবদ্ধ হবার যোগ্য নন, তাঁরা আসলে নষ্ট সমাজকে আরো বেশি নষ্ট করতে প্রকারান্তরে সহযোগিতা করেন। নিজেরা উৎকোচের বিনিময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ায় আজীবন মেরুদণ্ডহীন প্রাণীর মত শুধু বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা পর্ষদের কর্তা ব্যক্তিদের পদলেহন করেন। আমাদের সময়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের মত একজন শিক্ষক হিসেবে যে নৈতিকতা, দৃড়তা, বিদ্যানুরাগ, শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার প্রতি যত্নবান, দূর্বল শিক্ষার্থীদের অধিক সময় দিয়ে উঠিয়ে আনা ইত্যাদি গুণাবলী থাকা আবশ্যক তার কোনটিই আর অবশিষ্ট থাকে না বর্তমান টাকার বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ জনবলের। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আরো ভয়ঙ্কর, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগেও বর্তমানে কুড়ি লক্ষ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। এখনকার দিনে শিক্ষক নিয়োগে টাকা নেয়া খুবই মামুলি ব্যপার হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আর এই কারনেই আমি সহজে শিক্ষাকে পণ্য হওয়া থেকে রক্ষা করার কোন দিশা খুঁজে পাই না, হতাশায় নিজের আঙ্গুল কামড়াতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু এই বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের দানবীয় গো-গ্রাসে ক্ষতবিক্ষত সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যে গভীর সংকটের ইতিমধ্যে পড়ে গেছে তা থেকে বের হবার পথ প্রায় নেই। একমাত্র অভিভাবকদের সার্বিক সচেতনতা, প্রতিবাদ ও শিক্ষানুরাগী যথার্থ মানুষদের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এই কাজটি করতে হবে বিদ্যালয়গুলোর প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের, যারা পনেরো কুড়ি বছর আগে স্কুল থেকে পাশ করে বের হয়ে এখন সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে, সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে চাকুরি করছে। অভিভাবক ও স্থানীয় মননশীল মানুষগুলো নষ্টদের দ্বারা পুরোপুরিই আক্রান্ত ও পরাস্থ। তাদের সহায়তায়, তাদের প্রতিবাদী মনোবল ফিরিয়ে দিতে পুরাতন ঐতিহ্যবাহি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম দাড় করাতে হবে। শিক্ষার মৌলিক বিষয়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে শিক্ষা নিয়ে চলমান বানিজ্যের শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে একটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি শিক্ষার পরিবেশের মৌলিকত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তাহলে সারা দেশেই এই মডেল অনুসরণ করে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা শিক্ষাকে পণ্য হবার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে।
অত্যন্ত উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালইয়গুলোতে পর্যন্ত পরিচালনা পর্ষদ সৃষ্টি করা হয়েছে। যথারীতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধান্দবাজ অযোগ্য মানুষেরা দখল করে বসে আছে পরিচালনা পরিষদের সভাপতি ও সদস্য পদসমূহ। বিদ্যালয় ও শিক্ষার উন্নয়নের নামে এসব কমিটি তৈরি হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো মারিংকাটিং পর্ষদ। সবাই মিলে হরিলুটে অংশ নিয়ে হালুয়া রুটির ভাগবাটোয়ারা করাই এদের প্রধান কাজ। এর বাইরে তাদের সেই জ্ঞানটুকুও নেই যা দিয়ে বিদ্যালয় ও শিক্ষার উন্নয়নে খাটাবে, নেই নূন্যতম বিদ্যানুরাগ। সীমাহীন লোভ লালসার দাসেরা আজ পুরো শিক্ষা ও শিক্ষা অবকাঠামোগুলো গ্রাস করে বসে আছে। এদের শিকড় একদম গভীরে, আমরা জানি অলিখিতভাবে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত অবৈধ টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন মহানেতা, উপনেতা, নেতা, পাতি নেতা সব্বাই আনুপাতিক হারে। আর যে শিক্ষকদের হাত দিয়ে অবৈধ টাকাগুলো সংগ্রহ করা হয় অবাক হবার মত সত্য হল তাঁরা সেই অবৈধ টাকার ভাগ পান না বলেই চলে। তাঁরা শুধু চাকুরি বাঁচাতে পরিচালনা পর্ষদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সহযোগী হিসেবে নিজেদের উজাড় করে দেন। নূন্যতম লজ্জার ব্যাপার স্যাপার, রাখঢাক এখন আর অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু আমি বিশ্বাস করি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার আকালের এই মহা দূর্যোগের অবসান একদিন হতেই হবে। কারন কলুষিত মিথ্যার উপর শিক্ষার মত কোন মৌলিক ভিত্তি দাঁড়াতে পারে না। আমরা যে যেখানে আছি একটু সময় বের করে যার যার প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বর্তমান শিক্ষার পরিবেশ নিয়ে খোঁজ খবর করতে পারি বিবেকের তাগিদেই। আমরা যেটুকু মনুষত্ব বা সাফল্য আজ অর্জন করতে সমর্থ হয়েছি তা কিন্তু দিয়েছে আমাদের সেই শৈশবের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো, আমাদের অনেক ঋণ আছে সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে। এখন সেই স্মৃতিমাখা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর চরম দুঃসময়ে পাশে দাড়াবার সময় এসেছে। আমার কথা বিশ্বাস করুন, সারা দেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাড়ে সিন্দাবাদের ভূতের মত চেপে বসেছে পরিচালনা পর্ষদ নামক প্রকান্ড দৈত্য। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি সাধারণ ঝাড়ফুঁকে এদের বিতাড়িত করা সম্ভব নয়। সামাজিক আন্দোলন, অভিভাবকদের মধ্যে সচতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের মধ্যেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ইতিবাচক মানসিকতা তৈরি করার দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগুতে হবেই।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আর পিছু হটার পথ অবশিষ্ট থাকে না, শিক্ষা সংক্রান্ত অধঃপতনে আমাদের দেয়ালে শুধু পিঠই ঠেকেনি, মেরুদণ্ডও ইতিমধ্যে ভেঙ্গে গেছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে যার যার এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠাগুলোর খবর নিয়ে দেখেন অধিকাংশ বিদ্যালয়ের তহবিল ফাঁকা করে ফেলেছে চাটার দলের অশুভ প্রেতাত্মার দল। এখন তারা নজর দিয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী স্থাপনাগুলোর দিকে, সেগুলো ব্যবহার করে কিভাবে টাকা আয় করা যায় এবং আয়ের টাকা ভাগবাটোয়ারা করে মিলেমিশে ভোগ করা যায়। যেমন আমার শৈশবের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরী ভেঙ্গে দোকান ঘর নির্মানের মত ঘৃণ্য কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা কিছু প্রাক্তন শিক্ষার্থী মিলে সেই অপকর্মের প্রতিবাদ করে আপাত স্থগিত করতে পেরেছি এহেন নগ্ন কর্মকান্ড। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রকৃত শিক্ষানুরাগীরা না থাকলে যা হবার আমাদের বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আসুন আমাদের ঘুম ভেঙ্গে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে এসব অনাচার রুখে দিই ইতিবাচক মানুষদের সম্মিলিত শক্তিতে।
চলবে ………………………………
পল্লব খন্দকার, ০৩ সেপ্টেম্বর
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply