আমরা যদি নিজেদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ, সেগুলোর কর্মকান্ড এবং তার পিছনে লুকিয়ে থাকা বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা নিয়েই আলোচনা করতে চাই তাহলেও দিনের পর দিন রাতের পর রাত পার হয়ে গেলেও শেষ করা যাবে না। সামান্য একটি মাইক্রোস্কপিক কোষের অভ্যন্তরেই তো রয়েছে লক্ষ কোটি তথ্য, সেই অর্থে শরীরে একটি অঙ্গ নিয়ে বিস্তারিত বা গভীর বিশ্লেষণ করার সামর্থ্যও আমার নেই। শুধুমাত্র ছাত্র জীবনে বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছি সেই সুবাদে নিজের কাছে বিজ্ঞান বা প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টির সামান্য অংশ নিয়েই আমার এই প্রচেষ্টা। অনুসিদ্ধাৎসু পাঠকদের মনে কিছুটা বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি পৌঁছে দিতে পারলেই এ লেখা স্বার্থকতা পাবে।
ত্বক নিয়ে এর আগের পর্বে আমরা ত্বকের প্রধান তিনটি স্তরের মধ্যে এপিডার্মিস (বহিঃত্বক) নিয়ে আলোচনা করেছি, আজকের বিষয় ডার্মিস (মধ্যত্বক)। ত্বকের ডার্মিস স্তরটি তন্তুযুক্ত অংশ, এটি কোলাজেন (এক ধরনের সংযোজক কলা বা টিস্যু) এবং স্থিতিস্থাপক কলা (টিস্যু) সমৃদ্ধ। এছাড়াও ত্বকের এই অংশে অন্যান্য কোষ বহির্ভূত উপাদান যেমন রক্তনালী, স্নায়ুর শেষাংশ, চুলের উৎস্যমুখ বা ফলিকল এবং বিভিন্ন গ্রন্থি বা গ্লান্ড (যেমন- ঘাম গ্রন্থি, তৈল গ্রন্থি) থাকে। এসকল গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গানু সমূহের সমন্বয়ে ডার্মিস (মধ্যত্বক) অনেকগুলো কার্য সম্পাদন করে। এই অংশে অবস্থিত কোলাজেন ত্বকের নমনীয়তা এবং দৃড়তা রক্ষায় সহযোগিতা করে। আমরা তুলতুলে নরম ত্বক চাই আবার কুঁচকে যাওয়া ত্বক পছন্দ করি না, উভয়দিকেই আমাদের ত্বকের সুরক্ষা ও সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে প্রাকৃতিকভাবেই ব্যবস্থা করে রেখেছেন সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতি! মানব শরীর সৃষ্টির প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন বিস্ময়কর সমন্বয় কিভাবে ঘটেছে সেই রহস্য ভাবনা আমাকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। এই যে প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় অন্তর্ভূক্ত করে নিখুঁতভাবে আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গের কার্যক্রম বিন্যাস কিভাবে সম্ভব? এমনকরেই সৃষ্টির সকল রহস্য আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারনে উদ্ঘাটন করতে অপারগ হয়ে বিশ্বাসী হই একজন অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি। আমরা ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটুকু জানি, তিনি সমগ্র সৃষ্টিকূলের স্রষ্টা হয়ে তাহলে কতটা মহাজ্ঞানী তা আমাদের ভাবনার অতীত!
ত্বকের ডার্মিস (মধ্যত্বক) অংশটি আমাদের শরীরের স্নায়ুবিক বিভিন্ন অনুভূতি যেমন ব্যথা বা সুড়সুড়ি বুঝতে সহায়তা করে। তারমানে শরীরের বহিরাংশে আঘাতপ্রাপ্ত হলে অথবা কাতুকুতু দিলে এই অংশের মাধ্যমে আমাদের স্নায়ু মাথায় তথ্য পৌঁছে দেয়। এছাড়াও ডার্মিস (মধ্যত্বক) ত্বকের ও শরীরের গভীর অংশকে রক্ষা করে এবং দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এই অংশে থাকা ঘাম গ্রন্থি ঘাম নিঃসরণ করে দেহের জন্য উপযুক্ত তাপমাত্রা বজায় রাখে, অতিরিক্ত গরমের দিনে ত্বককে বাষ্পীভূত রেখে শীতল অনুভূতি সৃষ্টি করে। তৈল গ্রন্থি থেকে সিবাম নামক তৈলাক্ত পদার্থ নিঃসৃত করে ত্বকের উপরিভাগের আদ্রতা বজায় রাখে, ত্বকের কোমলতা ও উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে এবং ত্বককে বিভিন্ন জীবাণুর সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেয়। কতশত কাজ নিরন্তরভাবে চলতে থাকে আমাদের শরীরের প্রতিটি অংশে আমরা হয়তো খেয়ালও করি না। শুধুমাত্র যখন কোন অস্বাভাবিক ঘটনা তৈরি হয়, শরীরের কোন একটি অংশ ঠিকমত কাজ করে না তখুনি বুঝতে পারি শারীরিক সুস্থতার মূল্য কতোখানি?
মধ্যত্বকে থাকা চুলের উৎপত্তিস্থল বা ফলিকল শরীরের বিভিন্ন অংশে চুল বা লোম তৈরি করে, এই চুল বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন নাম ধারণ করে। অনেকটা নদীর নামের মতো, একই নদীর নাম কোথাও পদ্মা, কোথাও গড়াই কোথাওবা মধুমতি। শুধু মাথা ও মুখমন্ডল বিবেচনা করলেই আমরা মাথার উপরের অংশে জন্মানো উপাদানকে চুল, চোখের উপরের অংশের উপাদানকে ভ্রু, চোখের পাতায় থাকলে পাঁপড়ি, উপরের ঠোঁটের অংশে জন্মালে মোচ আর মুখে বা থুঁতনিতে থাকা চুলকে বলি দাঁড়ি। ব্যাপারটা বেশ মজার, একই বস্তুর বিভিন্ন নামকরণ হয় শুধুমাত্র অবস্থানগত কারনে। ফলিকল থেকে উৎপন্ন হওয়া চুলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির কাজের পাশাপাশি তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও বাইরের ক্ষত থেকে সুরক্ষা দেয়ার কাজের কথা আমরা আগেই জানি। তাই ডার্মিসে থাকা রক্তনালীগুলোর ভূমিকাও সহজে অনুমেয়। রক্তের মাধ্যমে ত্বকের বিভিন্ন অংশে পুষ্টি পৌঁছে দেয়া এবং দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে রক্তনালীগুলো চব্বিশ ঘন্টা আমাদের পরিচর্যা করে চলেছে। আপনাকে তাই কৃতজ্ঞ হতেই হবে হয় সৃষ্টিকর্তার প্রতি অথবা প্রকৃতির প্রতি।
এই যে হাজারো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষের ভিতরে চলমান লক্ষ লক্ষ ক্রিয়া বিক্রিয়া তা যদি আমরা একটি যন্ত্র বা ঘড়ির সাথে তুলনা করি তাহলে কি মিল খুঁজে পাই? এসব যন্ত্র তৈরি হয় বিজ্ঞানীদের অব্যাহত গবেষণা প্রচেষ্টায়, কোন কোন যন্ত্র তৈরিতে লেগে যায় শত শত বা হাজার বছর। বৈদ্যুতিক বাতি থেকে শুরু করে বিমান বা কম্পিউটার আবিষ্কারের পিছনে রয়েছে বিজ্ঞানের অমূল্য অবদান, এই আবিষ্কারের সুবিধা ব্যবহার করে আমরা আধুনিক সভ্যতায় পা রেখেছি। প্রতিনিয়ত গবেষণার মাধ্যমে এগুলোর আরো উন্নয়ন ঘটছে, আগের টেকনোলজি পুরাতন হয়ে পড়ছে, আসছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। আমরা যদি শুধু মোবাইল বা সেল ফোন প্রযুক্তির উন্নয়নের ব্যাপারটাই লক্ষ্য করি সেটাই বিরাট বিস্ময়ের কারণ! সেলফোন একাই রেডিও, টেলিভিশন, সিনেমা, ক্যামেরার বাজার হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সেই তুলনায় আমাদের শরীরের অঙ্গ ও অঙ্গানু সমূহের কার্যক্রম প্রযুক্তি কতটা সুপার ফাইন তা কি কখনো খেয়াল করে দেখি? লক্ষ কোটি বছর ধরে একই জীবন প্রযুক্তির ধারাবাহিকতা কিভাবে রক্ষিত হচ্ছে তার পিছনে কে বসে আছেন আমরা কি নিশ্চিত করে বলতে পারি?
(চলবে———————————-)
দৈনিক আলোকবর্তিকা।
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply