আমার দুই কন্যা। বড় কন্যার বিয়ে হয়ে গেছে। গত সপ্তাহে ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে গেল। দুই মেয়েই এখন তাদের স্বামীর সাথে সিডনিতে ।
ছোট বেলায় রূপকথার গল্পে পড়েছিলাম, এক রাজার প্রাণ থাকতো গভীর সমুদ্রের তলদেশে ঝিনুকের ভিতরে। আমি তো আর রাজা নই, আমি নগন্য, ছাপোষা শিক্ষক, এক অভাজন মাত্র। আমার প্রাণ আমার দুই মেয়ের বুকের পাঁজরে জমা রেখে ছিলাম। এক মেয়ে অনেক আগেই চলে গেছে, আরেকজন গত সপ্তাহে গেল।
আমার ছোট মেয়েটার জন্ম ভিক্টোরিয়ার ছোট্ট একটা শহরে, শহর না বলে গ্রামীন শহর বলাই ভালো। শহরটির নাম ওয়ারনামবুল। মেলবোর্ন থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দুরে। সেই প্রায় পঁচিশ বছর আগে সিডনি থেকে সরাসরি ওয়ারনামবুল চলে আসি। শহরটিতে ভিক্টোরিয়ার ডিকিন ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস আছে। ঐ ক্যাম্পাসেই আমার পিএইচডির কর্মযজ্ঞ। ছোট মেয়ে তখন মাতৃগর্ভে।
গবেষনার কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমার সুপারভাইজার জলজ প্রানীর পুষ্টি বিদ্যার বিরাট পন্ডিত। এই বিষয়ে তার জগত জোড়া পরিচিতি। কিছু দিন যেতেই বুঝতে পারলাম এর সাথে আমার হবে না। আমার সাথে বনিবনা হলো না। আমি যা বলি সুপারভাইজার শোনেন না, আবার সুপারভাইজার যা বলেন আমি মেনে নিতে পারিনা। দেশটা অস্ট্রেলিয়া, আর স্কলারশীপ আমার। কাজেই সুপারভাইজারের সাথে টাগ অব ওয়ারে লেগে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রায় ৬/৭ মাসের গবেষনার কাজ আবর্জনার বিনে ফেলে দিয়ে ডিকিন ইউনিভার্সিটির মেলবোর্ন ক্যাম্পাসে সম্পুর্ন নতুন বিষয়ে নতুন সুপারভাইজার ঠিক করা হলো। মেয়ের মায়ের কাছ থেকে মেয়ে ভূমিষ্ঠ হওয়ার ডাক্তারের দেয়া তারিখ জেনে সেই তারিখ থেকে দুই সপ্তাহ পরের এক তারিখে উঠবো এমনভাবে মেলবোর্নে বাসাও নেয়া হলো। স্কলারশীপের অর্থে সংসার চলে। বাটার আনতে ব্রেড ফুরায় অবস্থা। কাজেই যে তারিখে বাসায় উঠবো, তার থেকে দেরী হলে বিশাল মাশুল দিতে হবে।
দিন গননার পালা। কখন মেয়ে আসবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিকেলে ফিরেই মেয়ের মাকে জিজ্ঞাসা করি, কোনো খবর আছে? সে শুকনো মুখে আমার দিকে তাকায়। আমি বলি, একটু হাটাহাটি করো, নড়াচড়া করো। সে হাটাহাটি করে, নড়াচড়া করে। মেয়ে বোধহয় মাতৃজঠরে উষ্ণ পরিবেশে নড়াচড়া আর দুলুনিতে আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়, সাড়াশব্দহীন। মেলবোর্নে বাসা নেয়া হয়ে গেছে, ওয়ারনামবুলের যে বাসায় ভাড়া আছি তাদেরকেও বাসা ছাড়ার নোটিশ দেয়া হয়ে গেছে। মেয়ে সময় মতো না এলে বিশাল সমস্যায় পড়বো। মাঝে মাঝে মায়ের পেটের দিকে তাকিয়ে বলি, মারে লক্ষী সোনা, বেরিয়ে আয় মা, দেরী করিসনে।
আর মাত্র কয়েকদিন বাকি বাসা ছেড়ে দেয়ার আর মেলবোর্নে নতুন বাসায় ওঠার। একদিন ভোরে মেয়ের মা জানালো তার খুব ব্যাথা হচ্ছে। বেচারীর ব্যাথাক্লিষ্ট মুখ, আমার আনন্দে হাসি এসে গেল। অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার- নার্স পরীক্ষা করে বললো এটা ফলস পেইনও হতে পারে, আমরা আজ সারা দিন দেখবো। কাল বাসায় পাঠিয়ে দেবো। তুমি বাসায় চলে যাও।
মেয়ের মাকে হাসপাতালে রেখে বাসায় চলে এসেছি। বাসায় কেউ নেই। কিছুই ভালো লাগছে না। সুপারভাইজার আমাকে ছাড়তে চাইছে না। তার আত্মসম্মানে লাগছে। স্টূডেন্ট সুপারভাইজারকে ছেড়ে যাওয়া সুখকর কিছু না। বাথরুমে ঢুকেছি খোচা খোচা দাড়ি, শেভ করব। ল্যান্ড ফোন বেজে উঠলো। তখনও মোবাইল ফোন তেমনভাবে চালু হয়নি, চালু হয়েছে কিনা তাও জানিনে, আমার ছিল না। ফোনে এক মহিলা বেশ তাড়াহুড়ো গলায় বললো, আর ইউ মেরিনা বেগম’স হাসব্যান্ড?
ইয়েস আই এ্যাম।
কাম টু দি হসপিটাল কুইকলি।
শহরটিতে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট তেমন ছিল না, আমার গাড়িও ছিল না। বাজার করা, কেনা কাটা সবই সিটি সেন্টারে যেয়ে করতে হতো। আমার বাসা থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দুরে সিটি সেন্টার। উইকএন্ডে আমি আর মেয়ের মা সেই দুরত্ব টুকু হেটে হেটে বাজার করে বাজারের ব্যাগ দুইহাতে নিয়ে হেটে হেটে শহরের একমাত্র মেইন রাস্তা ধরে বাসায় ফিরতাম।
হাসপাতাল থেকে কুইকলি যেতে বলেছে। তাছাড়া বাসা থেকে হাসপাতাল যথেষ্ঠ দুরে। মেইন রাস্তায় দাড়াতেই একটা খালি ট্যাক্সি এগিয়ে এলো। ট্যাক্সিতে উঠতেই ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, হ্যাজ দি বেবি বর্ন? আমি একটু ভুরু কুচকে, জিজ্ঞাসা করলাম, হাউ ডু ইউ নো দ্যাট?
দিস ইজ এ ভেরী স্মল টাউন, মেট। ইউ টু ওফেন ওয়াক এলঙ দিস স্ট্রিট। আই হ্যাভ সিন ইউ মেনি টাইমস।
হাসপাতালের মেইন এনট্রেন্সেই একজন নার্সের মত দাড়িয়ে, ড্রাইভার নেমেছে, আমিও নেমেছি। আমাদের দিকে তাকিয়ে নার্সটি জিজ্ঞাসা করল, আর ইউ মি বেগাম? আমি বুঝিনি যে আমাকে বলছে। জীবনে নিজের নাম কখনও মি বেগাম শুনিনি। আমি ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। নার্স সিড়ির একধাপ নেমে এসে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলো, আর ইউ মি বেগাম? অমি বলি, ইয়েস।
কাম কুইকলি। উই হ্যাভ টেকেন মিসেস বেগাম ইন দি ওটি। ডক্টরস আর ওয়েটিং ফর ইউ।
নার্স আমার সারা শরীর ডিসইনফেকটেন্ট দিয়ে মুছে দিল। এপ্রন আর মাথায় নীল রঙের ক্যাপ ও পরিয়ে দিল। যেন আমিই সার্জনদের প্রধান। মেয়ের মা অপারেশন টেবিলে শুয়ে আছে। আমি দেখলাম, চেয়ে চেয়ে পুরো প্রকৃয়াটি। মায়ের পেটের ভিতর যেভাবে কাটা ছেড়া করলো,মেয়ের মায়ের প্রতি আবেগে, মায়ায় চোখ ফেটে পানি আসার উপক্রম। এত ধকলের ভিতর দিয়ে যেতে হয় একজন মাকে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে! আর সেই নারীকে আমরা সুযোগ পেলেই অবহেলা করি, অবজ্ঞা করি!
কি চমৎকার ভাবে দুজন ডাক্তার মিলে বাচ্চাটাকে বের করে আনলো। যেন একটা গোলাপী রঙের গোলাপের কুড়ি। কয়েকদিন বিভিন্ন ঝামেলায় খুব বেশি ব্যস্ত ছিলাম, সেই সাথে টেনশন। মেয়ের নাম ঠিক করা হয় নি। বাচ্চা হওয়ার সাথে সাথেই হাসপাতালে রেজিস্ট্রি করতে হয়। বাচ্চার নাম প্রয়োজন। ওরাই নাম দিয়ে দিল। মিসেস বেগম, মিস্টার বেগম এর বাচ্চা, বেবি বেগম। নার্স সন্দর করে গোলাপী টাওয়েল দিয়ে মুড়ে আমার কোলে এনে দিয়ে বলল, নাও তোমার বেবি বেগম কে কাডল দাও।
মেয়েকে বুকের কাছে টাওয়েলসহ জড়িয়ে ধরে আছি। আর মেয়ে ড্যাব ড্যাব চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দুচোখ ভরা বিষ্ময়, কিছুটা অভিমান, কিছুটা অভিযোগ, সেই সাথে চোখে মুখে প্রত্যয়ের আভা । যেন বলছে, এত টেনশন কেন করছিলে বাবা? আমি কি তোমাকে কোনো ঝামেলায় ফেলতে পারি! আমি যে তোমার মা। এই যে আমি!
আমার মা ও বলতেন, এই যে বাবা, এই যে আমি!
চরম দুঃসময়ে যখন চারিদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ত না, রাতে মার সাথে মায়ের বিছানায় ঘুমাতে যেতাম । ঘুম আসত না। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখনও হয়ত দুচোখ একটু লেগে আসত, দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমের ভিতরেই হয়ত কেদে উঠতাম শব্দ করে। সাথে সাথে মা বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, এই যে বাবা, এই যে আমি।
বড় মেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই ছোট মেয়েটা যেন হয়ে উঠলো আমার আর আমার মেয়ের মায়ের, অন্ধের যষ্ঠি, ছায়া সংগী। অফিস থেকে বাসায় ঢুকেই দরজার কাছ থেকেই ডাকি, বুড়ি!
জবাব আসত, জী বাবা! এই যে আমি।
বয়স হয়ে গেছে। পেট মোটা হয়ে গেছে আমার, ঠিক মতো পায়ের নখ কাটতে পারি না। তাছাড়া বাগানে কাজ করি, পায়ের তলা মাঝে মাঝেই কালচে হয়ে যায়। একদিন মেয়ে আমার পায়ের তলা দেখে আঁতকে উঠলো, ইয়্যাক, তোমার পায়ের তলা এত নোংরা কেন? নখও তো বড় বড়। নখের ভিতর মাটি। যাও পেডিকিউর করে আসো।
আমার ধারনা পেডিকিউর, ম্যানিকিউর্, ফেশিয়াল সবই মেয়েদের রূপচর্চ্চা সংক্রান্ত। পুরুষের কিছু না। আমি বলি, মাথা খারাপ তোর! ঐ মহিলাদের ভিতর আমি একা পুরুষ বসে বসে হাতে পায়ে নেইল পলিশ নেব।।
এসব ব্যাপারে, আর এমন সব জায়গায়, বিশেষ করে নারী রাজ্যে, আমার আড়ষ্ঠতা মেয়ে আমার ঠিকই জানে। মেয়ে বললো, তুমি রেডি হও আমি তোমাকে নিয়ে যাব।
মেয়ে নিয়ে গেল। একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজেও আরেকটা চেয়ারে বসলো। কাউন্টারে কি বলল জানিনে। এক মহিলা এসে আমার পা দুটো আমার পায়ের ঠিক নীচেই ফুট স্পাতে ডুবিয়ে দিলো। ঈষদুষ্ণ পানি। নরম গদির চেয়ার। মহিলা হালকা ভাবে পা ম্যাসাজ করে দিচ্ছে। আরামে তৃপ্তিতে ঘুম ঘুম লাগছে। চোখ বন্ধ করে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতে চাইছি না। বারে বারে মেয়ের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। আমি জানি মেয়েও আড়চোখে আমাকে দেখছে। সন্তান যখন তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া শেষ করে, বা কোনো কিছু পেলে আনন্দে তৃপ্তিতে চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক বয়ে যায়্, মা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন । আমার মেয়েও আমাকে দেখছে, ঐভাবে।
ছুটির দিনে বা অন্যান্য দিন সন্ধ্য়ায় বাসায় ফিরে কিছুক্ষন পর পর বিনা কারনে বুড়ি বলে না ডেকে আমি থাকতে পারি না । বিকেলের দিকে হয়ত নিজের স্টাডি রুমে বসে কম্পিউটারে কাজ করছি। ঘর অন্ধকার হয়ে এসেছে। চেয়ার থেকে উঠে লাইটের সুইচ অন করতে ইচ্ছে হতো না। ডাক দিই, বুড়ি।
আমার স্টাডি রুম থেকে মেয়ের বেড রুম অনেক দুরে। মেয়ে আমার রুমের দরজার কাছে হাজির।
কি বাবা, ডাকছো কেন?
মারে লাইটের সুইচটা অন করে দে-না।
সে আমার দিকে কিছুক্ষন অবাক হয়ে তাকিয়ে একটু রাগত স্বরে লাইটের সুইচ অন করতে করতে বলে, এই জন্যে তুমি আমাকে ডেকেছ, সেই আমার বেড রুম থেকে? তুমি হাত বাড়ালেই তো সুইচটা অন করতে পারতে!
তা পারতাম রে মা! কিন্তু কতক্ষন যে তোকে দেখি না।
মেয়ে তারপরও কপট রাগে বলে, বাবা! আমি চলে গেলে কি করবে?
আজ কয়েকদিন হয়ে গেলো। মেয়েটা আমাদের সাথে নেই। রাতে ঘুম হয় না। মাঝে মাঝে ওর রুমের সামনে দিয়ে হাটি, দাড়িয়ে থাকি ওর রুমের দরজার কাছে। এ কয়দিন বাসায় টিভি চলে না। অথচ আমার মেয়ে বাসায় থাকবে আর টিভি চলবে না, তা কখন হয়নি। ফোন বেজে উঠলেই বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। মেয়েটা কি কাদছে! মেয়ে কিছুক্ষন পর পরই মাকে ফোন করে, আমি কান খাড়া করে থাকি।
ফ্যামিলি রুমে পাচ সিটের সোফার একটা চেয়ার আমার মেয়ের পছন্দের। ঐ চেয়ারটা ছাড়া ও আর কোনোটায় বসত না। আমি ঐ চেয়ারটাই বসি না। কেউ বসলেও আমার ভাল লাগেনা। মেয়েটা আসবে, তার সোফায় বসবে। থাক না ওটা ওভাবেই। ডাইনিং রুমে খাওয়ার টেবিলে বসে যখন কম্পিউটার নিয়ে কাজ করি। কিছুক্ষন পর পর ওই চেয়ারটার দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারি না।
জীবন থেমে থাকে না। আমার আর মেয়ের মা, আমাদের দুজনের জীবনও থেমে নেই। চলছি, ফিরছি, কাজ করছি, খাচ্ছি-দাচ্ছি, এর ওর সাথে কথা বলছি, হাসছিও হয়ত। কাজ শেষে বাসায় ফিরে সন্ধ্যার খাওয়া দাওয়ার পর আমি আমার স্টাডি রুমে, মেয়ের মা বেড রুমে। আমরা দুজনের কেউই মেয়েটার স্মৃতিচারন সম্পর্কীয় কোনো আলাপ করিনা। কিচেনে উনি রান্না করেন, নিঃশব্দে। নীরবতা ভাঙার জন্যে আমি হয়ত একটু কিচেনে যেয়ে জিজ্ঞাসা করি। কি করছ? তারও উত্তর, এই তো, এই! ব্যাস কথা ফুরিয়ে যায়। মায়ের মেয়ের দিকে মাঝে মাঝে তাকাই। এই তাকানোর ভিতর দিয়ে চোখে চোখে অনেক ভাষা পড়ে ফেলি। চোখ দুটি যেন বলে, আমার তো বুকটা ফেটে যাচ্ছে, তোমার যাচ্ছে না? কিংবা আমার চোখের ভাষাও হয়ত উনি এভাবেই পড়েন। প্রাণহীন আমরা দুজন এই বাড়িটার দুইকোণে চুপ চাপ বসে রই। অপেক্ষায় থাকি।
সারাক্ষন দোয়া করি। আমার দুটি মেয়ের জন্যেই। যাদের বুকের পাঁজরে আমার প্রাণ তাদের জন্যে মুখে মুখে মুখে দোয়া কিছুক্ষনের জন্যে থামলেও, মনের ভিতর দোয়ার জিকির বয়ে যায়, অবিরত। আমার মেয়ে দুটি যেন ভাল থাকে, সুখে থাকে। পৃথিবীর কোনো দুঃখ কষ্ট যেমন আমার মেয়ে দুটির এতটুকু স্পর্শ না করে।
সেই ছোটবেলা থেকে আমি কল্পনা প্রবন। বালক বয়সে যখন কিছু দিন গ্রামে ছিলাম, শীতের সকালে খেজুর গাছ থেকে রসের হাড়ি নামানো গাছি ছিল আমার আদর্শ মানুষ। কল্পনা করতাম আমি বড় হলে গাছি হবো। আমার কল্পনা কোনো অলীক কল্পনা নয়, আমার কল্পনার উৎস আমার জীবনে দেখা দৃশ্য, কাহিনি, ঘটনা থেকেই।
আমার বাবার চিরতরে চলে যাওয়ার দৃশ্যটা আমি আজি এবয়সেও এতটুকু ভুলতে পারিনা। প্রতিটা মুহূর্তের ছবি আমি আমার মস্তিস্কের পর্দায় রিওয়াইন্ড করতে পারি।
১৯৭১ এর অগাস্টের ভোর বেলা। বাবার অন্তিম মুহূর্ত। উনি ঘোরের ভিতর চলে গেছেন । আমার মা অঝোরে কাঁদছেন, প্রলাপ বকে যাচ্ছেন। শোনো, তুমি যে চলে যাচ্ছ, আমাদের কার কাছে রেখে যাচ্ছ? এই বাচ্চাদের কোথায় রেখে যাচ্ছ। এদের নিয়ে কোথায যাব?
বাবা শুনতে পাচ্ছেন কি না জানিনে। সমস্ত শরীর নিথর। হঠাৎ উনি ডান হাতটা আস্তে আস্তে উচু করার চেষ্টা করলেন। ডানহাতের তর্জনী শুধু উপরের দিকে তুললেন। ওনার মুখটা যন্ত্রনায়, মানসিক কষ্টে কেমন যেন কালচে হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যায়্, এই কষ্টের চিহ্ন শারীরিক কোনো কষ্টের কারনে নয়্। প্রবল দুঃখ বোধ। ওনার দুই চোখের দুই কোন দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। উনি মারা গেলেন। আমার মা শুধু চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন, আল্লাহ গো, আমি এই এতিম বাচ্চাদের এখন কিভাবে বাচাবো।
বয়স হয়ে যাচ্ছে। জীবন সায়াহ্ন এসে গেছে। পরিনতিও খুব বেশি দেরী নেই। বুঝতে পারা যায়। আমি আমার অন্তিম দৃশ্য কল্পনা করি। হয়ত হাসপাতালে নতুবা নিজের বাসার বিছানায় শুয়ে আছি। বিদায় কাল উপস্থিত। আমার প্রিয়জনেরা অঝোরে কাঁদছে আমার পাশে। আমার দুই পাশে আমার দুই মেয়ে, তাদের স্বামীরা তাদের হাত শক্ত করে ধরে আছে। আমার দুই মেয়ের কোলেই তাদের যার যার সন্তান। আমার মেয়ে দুটি কাদছে তাদের বাবার জন্যে। আর তাদের দুটি সন্তানই বার বার তাদের মায়েদের দিকে তাকাচ্ছে আর ঠোট ফুলাচ্ছে। আমার দুচোখের দুই কোণা দিয়ে গড়িয়ে পরবে পানি, অবয়বে প্রশান্তির ছায়া, ঠোটের কোণে ঈষৎ হাসি।
দয়াময়, তাই যেন হয়।
লেখা সংগ্রহ: জনাব সাদিকুল আওয়াল এর ফেসবুক ওয়াল (https://web.facebook.com/sadiq.awal.39)
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
পূনশ্চ: জনাব সাদিকুল আওয়াল অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী, তিনি অত্যন্ত শক্তিমান লেখক। আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের একজন প্রিয় শিক্ষক, স্যারের কাছে অনুমতি না নিয়েই ফেসবুকে দেয়া লেখাটি প্রকাশের জন্য অগ্রীম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
লেখাটায় আমার বাবার প্রতিচ্ছবি পেয়েছি। হয়তো সব মেয়েরাই তার বাবাকে দেখতে পাবে। অনেক অনেক শুভকামনা স্যার। ভালো থাকবেন।