অসংখ্য নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে। “সবার জন্য শিক্ষা” এমন বুলি আওড়ালেও এদেশে শিক্ষার শত্রু হিসেবে পারিবারিক দারিদ্রতা একটি প্রধান অন্তরায়। আমি আমার চোখের সামনেই অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর স্কুল থেকে ঝরে পড়তে দেখেছি শুধুমাত্র পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারনে। এই ব্যাপারটি গত দুইশত বছর ধরেই বিদ্যমান আমাদের সমাজে, দারিদ্রতার কারনে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্কুল থেকে ঝরে পড়ে রুটি বেলার কাজ করেছেন। দরিদ্র পরিবারের খুব ভাগ্যবান কেউ কেউ সমাজের শিক্ষানুরাগী মানুষদের সহযোগিতা নিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা অন্যদের কাছে সহানুভূতি পেয়ে থাকে, দরিদ্র পরিবারের কম মেধাবীদের ভাগ্যে আর শিক্ষা জোটে না। পারিবারিক দারিদ্রতার কারনে আমার স্কুল সহপাঠী কয়েকজন বন্ধু কলেজে পড়ার সুযোগ পায়নি, পরিবারের ঘানি টানতে কেউ বা হয়ে গেছে রিক্সাচালক বা দিনমজুর।
অত্যন্ত দূর্ভাগ্যজনক অবস্থার স্বীকার হয়ে অবর্ণনীয় ভোগান্তিতে পড়ে সারাটি জীবন বঞ্চিত হয়ে থাকে বহু লেখাপড়া না শেখা মানুষ। অথচ রাষ্ট্র যদি বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে কমপক্ষে কারিগরি শিক্ষা নেয়ার সুযোগ সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে পারে তাহলে সহজে কেউ শিক্ষা বঞ্চিত হতো না। সেক্ষেত্রে কর্মমূখী শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে কাউকেই আর বেকারত্ব অথবা উপযুক্ত কর্মের অভাবে পড়তে হতো না। আমাদের দেশ জনবহুল, অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে অভিশাপ হিসেবে দেখানোর প্রবনতার বিপরীতে অধিকাংশ মানুষকে বিনামূল্যে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নেয়া হলে আজ বিদেশে দক্ষ জনশক্তি পাঠিয়ে অধিক জনসংখ্যাকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখার সুযোগ পাওয়া যেতো। দুঃখজনক হলো দেশের কোন সরকারই ব্যাপারটাকে এইভাবে দেখেননি, দেশের মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনার্স বা বিএ এমএ পাশের অদক্ষ বেকার সৃষ্টির প্রতি শুধু জোর দিয়ে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে।
দেশের সরকারগুলো যেভাবে অবকাঠামো উন্নয়নে জোর দিয়ে থাকে পাশাপাশি শুধুমাত্র কর্মমূখী শিক্ষাকে জোর দিয়ে ধরতে পারলে আর কোনদিন পিছিয়ে পড়বে না বাংলাদেশ। আবারো বলছি প্রচলিত অনার্স মাস্টার্স পদ্ধতির লেখাপড়ায় দিনে দিনে পঙ্গু হবার পথে জাতি। আমরা এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে দক্ষ ব্যবস্থাপক খুঁজে পাই না শুধুমাত্র অনার্স মাস্টার্সদের ঠেলায়। মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর পাশ ফেল পদ্ধতিতে কোন ধরনের কর্মমূখী শিক্ষার সুযোগ থাকে না। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শুধু গৎ বাঁধা সিলেবাসের মধ্যে নিজেদের জ্ঞান সীমাবদ্ধ করে রাখে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার কোন গুণাবলী অর্জনের লক্ষ্যে থাকে না কোর্স কারিকুলাম। গাইড মুখস্ত করে পাশ করা শিক্ষার্থীরা চাকুরী জগতে প্রবেশ করে চাকরই থেকে যায়, ভালো ব্যবস্থাপক বা টীম লিডার হতে ব্যর্থ হয়।
ক্ষতি যা হবার তা প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। শিক্ষা ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে এ দেশের শিক্ষা ইতিমধ্যে পণ্য হিসেবে ট্রেডমার্ক হয়ে পড়েছে। এক্ষুনি সময় লাগাম টেনে ধরার, জোর করে হলেও মেধাবীদের কর্মমূখী শিক্ষার সাথে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। সেজন্য আর একটিও অনার্স কলেজ খোলার অনুমোদন না দেয়া, সরকারি উদ্যোগে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনা করা এবং শিক্ষাখাতে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ দিয়ে কারিগরিভাবে দক্ষ শিক্ষক তৈরি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা। অবশ্যই পর্যায়ক্রমে সমস্ত বেসরকারি বিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে সরকারিকরণ করে নেয়ার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। সেখানে অযোগ্য অদক্ষ শিক্ষকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেক দিয়ে অব্যাহতি দেয়ার ব্যবস্থাটিও গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে।
আশা করি বিশেষতঃ গ্রাম এলাকার বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বর্তমান শিক্ষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার এই লেখাগুলোয় যারা নিয়মিত চোখ রেখেছেন তাঁদের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ করতে না পারলেও মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও সমাধানের কিছুটা পথ নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। মূলতঃ মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষক সংকট দূরীকরণে উদ্যোগ নিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের প্রচেষ্টাই ছিলো লেখাগুলোর মূল বক্তব্য। এছাড়া আমাদের দেশে ও সমাজে শিক্ষকদের হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে আনার আকুতি ফুটিয়ে ওঠাতে চেয়েছি সব লেখাতেই। জাতির মেধা ও মননের সৃষ্টিশীলতার মূল কারিগর শিক্ষা গুরু ও শিক্ষা সেকটর নিয়ে আমার ধারাবাহিক লেখাটি এই পর্বেই শেষ করছি, আগামীতে নিশ্চয়ই শিক্ষা সংক্রান্ত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হবো।
আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করছি গত দশটি পর্বে গ্রামীন এলাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার লেখাগুলো নিজের গ্রামের শৈশবের স্কুলের অভিজ্ঞতায় লেখা, এটি কোনভাবেই সারাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবে না। এছাড়া আমার মাধ্যমিক স্কুল জীবনে সান্নিধ্য পাওয়া পরম শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক প্রয়াত শেখ শামসুর রহমানকে আদর্শ শিক্ষক হিসেবে ধরে নেয়ায় বর্তমান শিক্ষকদের কিছুটা হেয় প্রতিপন্ন করার মতো দূর্বলতা ছিলো লেখাগুলোয়। আশা করি কেউ ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না, আমার একমাত্র উদ্দেশ্য শিক্ষকদের যৌক্তিক মেধা ও নৈতিক শিক্ষার আলোয় যেন আলোকিত হয়ে ওঠে প্রিয় বাংলাদেশ।
পল্লব খন্দকার, ১৮ অক্টোবর ২০২৩
mazhabkh93@gmail.com
Leave a Reply