আমাদের জীবনটাই এখন যেন ফেসবুকময় হয়ে উঠেছে! যতক্ষণ জেগে আছি ফেসবুকের প্রতিটি পোস্টে চোখ বুলিয়ে অথবা নিজেরই কোন স্ট্যাটাস দিয়ে যুক্ত থাকাটা যেন অবশ্য কর্তব্য হয়ে উঠেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। তাই জ্ঞানের কথা বলেন আর হাসির কথা বলেন ফেসবুকই এখন আমাদের জীবনের প্রধান শিক্ষক হয়ে উঠেছেন! ফেসবুকে প্রচারিত অনেক আদেশ নির্দেশ উপদেশ নিয়ে তাই আমরা মাথা ঘামাই, চিন্তার খোরাক জন্ম দেয় মনে। যেমন ফেসবুকে একটা কথা আজকাল সবসময়ই দেখছি, “নিজের ব্যাক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে কারোর প্রিয় হওয়ার চাইতে একা থাকা অনেক ভালো……..”
কথাটা আমার মাথায় গিয়ে আঁটকে গেল… বোঝার চেষ্টা করলাম কথাটার নিগূঢ় অর্থ।
ভাবনায় যোগ-বিয়োগ করে আমার জ্ঞানে যা বুঝলাম তা হলো, কথাটা গভীরভাবে ভাবলে বোঝা যায় যে লেখাটাতে বিরাট একটা ভুল আছে……
আসলে কেউ কারো ব্যাক্তিত্ব বিসর্জন দিতে পারে না। কারন ব্যাক্তিত্ব হলো একজন মানুষের সার্বিক আচরণের একান্ত প্রকাশ মাত্র, এখানে বিসর্জন দেয়ার কিছু নেই। আপনি আসলেই যা আপনার অন্তর্গত ব্যাক্তিত্বও সেভাবেই অন্যদের কাছে উপস্থাপিত হবে। সাধারণভাবেই কারো কাছে আপনার ব্যাক্তিত্ব খুবই গ্রহণযোগ্য হবে আবার কারো কাছে বা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য থাকবে। আপনার শারীরিক অবয়ব যেমন ইচ্ছে করলেই পরিবর্তন করতে পারবেন না তেমনই আপনার অন্তর্গত ব্যাক্তিত্ব কোন চাপে পড়ে বা প্রয়োজনের খাতিরে খুব বেশি পরিবর্তন করতে পারবেন না। ব্যাক্তিত্ব হলো আয়নার মতো, আপনি যা সেটারই প্রতিফলন দেখতে পাবেন আপনার নিজেকে প্রকাশের সবগুলো পর্যায়ে। তবে হ্যাঁ, মানুষের ব্যাক্তিত্ব বিষয়টি ধরা বা ছোঁয়ার মতো বস্তু না হলেও তা দেখার একটা ব্যাপার আছে, এটি বায়বীয় হলেও তা মানুষকে স্থায়ীভাবে আকর্ষিত করে থাকে।
যেমন সৌন্দর্য্য দিয়ে মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য আটকানো যায়, সৌন্দর্য্য মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে তবে ব্যক্তিত্ব মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ফেসবুক দিয়েই শুরু করা যাক। আধুনিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার এই যুগে ফেসবুক একটি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ কোটির অধিক লোক ফেসবুক ব্যবহার করে আর পৃথিবীতে প্রায় তিনশো কোটি। ফেসবুক দিয়েই কেন লেখা শুরু করলাম? কারণ জনসংখ্যার বড় একটা অংশ এখন ফেসবুকমুখী, সময় আর সুযোগ পেলেই ফেসবুকে ঢু মেরে আসে আবার অনেকের অবসর সময় কাটে ফেসবুক চালিয়ে। একটি ফেসবুক আইডিতে একজন ব্যক্তির ব্যাক্তিত্ব, রুচি, মানসিকতা, আদর্শ, চিন্তার পরিধি ইত্যাদি ফুটে ওঠে। একজন ব্যাক্তির টাইমলাইম ঘুরে আসলে তাঁর ব্যাক্তিত্ব, রুচি ও মানসিকতা সম্পর্কে অনেকটা ধারণা নেওয়া যায়। যদিও মানুষের মনের খবর সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন কিন্তু বাহ্যিক দেখেই আমরা সাধারণত মানুষকে বিচার করে থাকি। এই যুগে যেহেতু আপনার ফেসবুক আইডির অ্যাক্টিভিটিস বিবেচনা করে ব্যাক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায় সেহেতু ফেসবুক ব্যবহারে আমাদের সচেতনতা বৃদ্ধি ও অধিক মনোযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আসুন একটু তাত্ত্বিক আলোচনা করে নিই, ব্যাক্তিত্বের সংজ্ঞা অর্থাৎ ব্যাক্তিত্ব কি?
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাক্তিত্ব হচ্ছে “কোনো একজনের মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণের এমন এক স্বতন্ত্র ধরন, যা কেবল তার মধ্যেই বিদ্যমান থাকবে যেটি কিনা অন্যদের কাছ থেকে সেই ব্যাক্তিকে আলাদা করবে।”
তাহলে দেখা যাচ্ছে কেউ তার ব্যাক্তিত্ব অন্যের জন্য বিসর্জন দিতে পারে না কারণ মানুষ কখনও অন্যের কথায় চলতে পারে না, যদিও কখনও সে তা করে তবে সেটা হবে অনুকরণ… নিজের ব্যাক্তিত্ব বিসর্জন নয়। অনুকরণের স্থায়িত্ব বেশীদিন হয় না। কারণ মানুষ তার নিজের মতই চলে, মানুষের নিজস্ব ব্যাক্তিত্ব আছে এবং সেগুলোই তার বেঁচে থাকার সাথী। সহজ করে বললে- ব্যাক্তিত্ব হলো একজন ব্যাক্তির এমন গুণ/বৈশিষ্ট্য যা অন্যের কাছে তাকে আকর্ষণীয় বা বিরক্তিকর করে তুলবে এবং অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াবে অথবা কমাবে।
সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ তার ব্যাক্তিত্বের কারণেই কোথাও স্মরণীয় কোথাও সম্মানীয় আবার বিতর্কিত ব্যাক্তিত্বের কারণে কোথাও নিন্দনীয়। মূলত যে ব্যাক্তিত্ব একজন মানুষকে আলোকিত করে সেক্ষেত্রে নিজের ব্যাক্তিত্ব নিজেকেই নির্মাণ করতে হয়। ব্যাক্তিত্ববান মানুষ হওয়ার তীব্র আকাক্ষা বা প্রচেষ্টা অনেকের মাঝেই বিরাজমান। কারণ ইতিবাচক ব্যক্তিত্ববান মানুষকে সবাই পছন্দ করে, একজন মানুষের ব্যাক্তিত্ব কেমন তা প্রকাশ পাবে তার আচরণে, মানুষ তার মনের মধ্যে কি চিন্তা লালন করে তার প্রকাশ পায় আচরণে। ইতিবাচক ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন মানুষেরা সব জায়গায় তার ব্যাক্তিত্বের ছাপ ফুটিয়ে তোলেন।
স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে যে সকল গুণ থাকলে আমরা ব্যাক্তিত্ববান হিসেবে গণ্য করি কিংবা ব্যাক্তিত্ববান হওয়ার জন্য যে গুণগুলো থাকা দরকার এবার তাহলে সে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক।
• অন্যকে সম্মান দেয়া
• জ্ঞানগত যোগ্যতা বাড়ানো
° কথা দিয়ে কথা রাখা
° কথা কম বলা
° চরিত্রবান হওয়া
° ব্যক্তিগত বিষয় অন্যকে শেয়ার না
° সবকিছুতে ইতিবাচক চিন্তা করা
° ক্ষমতার অপব্যবহার না করা
° আত্মপ্রচার না করা
মূলত ইতিবাচক বিভিন্ন গুণাবলি দ্বারাই মানুষের সুন্দর ব্যাক্তিত্ব নির্ধারিত হয়। মানবিক গুণাবলি যে যত বেশি অর্জন করতে পারবে এবং অসৎ মানবীয় গুণাবলি থেকে যে যত বেশি বিরত থাকতে পারবে তার ব্যাক্তিত্ব আকাশের উজ্জ্বল তারকারাজির ন্যায় চতুর্দিকে দ্যূতি ছড়াবে। ব্যাক্তিত্ব হলো মানবসম্পদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সম্পদ, যার মধ্যে এই সম্পদ আছে তার আর অন্য কোন সম্পদ না হলেও চলবে। তাই প্রকৃত ব্যাক্তিত্ববানরা আদর্শ ব্যাক্তিত্বের কারণে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন আর তার বিপরীতে ব্যক্তিত্বহীনরা ব্যাক্তিত্ব বিকিয়ে দিয়ে স্বার্থ হাসিল করে। কবির ভাষায়-
‘পানির দরে বিকিয়ে দিতে পারি সব
সোনার দামেও আত্মসম্মান না
যদিও কাকফাটা রোদে তামাম দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়
যদিও ক্ষুধায় পেট করে খাঁখাঁ’
আমাদের সমাজে কিছু কিছু কথার প্রচলন আছে যেগুলোর কোন অর্থবহ করে না এবং অজ্ঞতার প্রকাশিত হয় সেসব কথাগুলোতে।তবে সমাজের মানুষের মুখে মুখে কথাগুলো চলছে। আর অনেক মানুষই সে সব বিবেচনা না করে সেটা সত্য কথা মনে করে এবং কথাবার্তায় চালিয়ে যায় গুরুত্বপূর্ণ কথা ভেবে।
পরিশেষে বলবো, ব্যাক্তিত্ব হলো চিন্তা, অনুভব, এবং আচরণ যা একটি মানুষের নিজের। এটা কেউ বিসর্জন দিতে পারে না মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কারণ মানুষের ভাবনা এবং আচরণই তার ব্যাক্তিত্ব।
বনানী ঘোষ, খুলনা থেকে।
সংকলন: দৈনিক আলোকবর্তিকা।
Leave a Reply